ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একটি ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের অপমৃত্যু, ১৬৫ কোটি টাকা গেল জলে

কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের নামে ২৫৮ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প শুরু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৩ মে ২০১৭

কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের নামে ২৫৮ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প শুরু হচ্ছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ হিসেবে পরিচিত কর্ণফুলী নদীতে পুনরায় ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। আগামী মাসের দিকে এ বিষয়ে টেন্ডার আহ্বান করা হবে বলে বন্দর সূত্রে জানানো হয়েছে। তবে প্রায় ৪ বছর আগে কর্ণফুলী নদীতে যে ড্রেজিং প্রকল্প শুরুর পরই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘটনায় ১৬৫ কোটি টাকা রানিং বিল হিসেবে হাতিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন (এমএমডিসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে উল্লিখিত অর্থ গ্রহণ করে পালিয়ে যাওয়ার পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়ে কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ২২৯ কোটি টাকা। ওই মালয়েশীয় কোম্পানি ২০১১ সালে কাজ শুরু করে পরবর্তীতে বন্ধ করে পালিয়ে যাবার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) তাদের কাজ বাতিল ঘোষণা করে এবং ওই কোম্পানির যন্ত্রপাতিসহ ১৯ কোটি টাকার মালপত্র জব্দ করে। এ নিয়ে মালয়েশিয়ান কোম্পানির পক্ষ থেকে উচ্চ আদালত মামলা দায়ের হলে আদালত ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত ড্রেজিং কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাদ দিয়ে ডিপিএম (সরাসরি সংগ্রহ) পদ্ধতিতে সদরঘাট থেকে চর বাকলিয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকায় নদী থেকে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪২ লাখ ঘনমিটার বালিসহ বর্জ্য অপসারণ প্রকল্প গ্রহণ করে। সদরঘাট থেকে চর বাকলিয়া পর্যন্ত নাব্য রক্ষা নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ সরকারী একটি সংস্থার কাছে দেয়ার সুপারিশ রয়েছে। তবে অবশ্য তা টেন্ডারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। উল্লেখ্য, দীর্ঘ সময়জুড়ে আদালতে মামলা চলার পর সদরঘাট থেকে চর বাকলিয়া পর্যন্ত ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা হলে মালয়েশিয়ান কোম্পানিটি যে ১৬৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এ ব্যাপারে আদালতের চূড়ান্ত কোন নির্দেশনা আসেনি। বিষয়টি আরবিট্রেশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এদিকে, কর্ণফুলী নদীর দু’পাড় জুড়ে ২ হাজার ১৮১ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের রায়ের পরও বিষয়টি ঝুলে আছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সরকারী কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে এ রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে নতুন নতুন করে আরও অবৈধ স্থাপনা স্থান করে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন হাইকোর্টে রিট করার পর শুনানি শেষে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদী তীরে যে কোন ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন আদালত। একই সঙ্গে বছরের পর বছর গড়ে উঠা ২ হাজার ১৮১ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনাও প্রদান করা হয়। একদিকে অবৈধ দখলে কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা যেমন হ্রাস পেয়েছে। তেমনি উজান থেকে নেমে আসা পলিমাটি ও বর্জ্য অপসারিত না হওয়ায় এর নাব্য ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে খ- খ- চর। যে কারণে চার ফিট ড্রাফটের ছোট জাহাজও চলাচল করতে পারে না। বন্দর সূত্রে জানিয়েছে, সরকার ডিপিএম পদ্ধতিতে যে ড্রেজিং প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে তা সম্পন্ন হলে সদরঘাট থেকে চর বাকলিয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকায় চার থেকে পাঁচ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করতে পারবে। ইতোপূর্বে এমএমডিসি যে পরিমাণ বালি ও বর্জ্য উত্তোলন করে নদীর পাড়ে রেখেছিল সে বালি ও বর্জ্য দীর্ঘ সময়ে পুনরায় নদীতে গিয়ে পড়েছে। ফলে নাব্য সঙ্কটে কাতর হয়ে আছে কর্ণফুলী নদী। চর বাকলিয়া এলাকায় ভাটার সময় যে পরিমাণ এলাকা ভরাট হয়ে গেছে তা দিয়ে জনচলাচলও হয়ে থাকে। বিষয়টি কর্ণফুলী নদীর জন্য ভয়াবহ একটি ঘটনা হলেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের ততবেশি মাথাব্যথা ছিল না বললেই চলে। আদালতের ওপর হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমানে ডিপিএম পদ্ধতিতে যে নতুন প্রকল্প নেয়া হয়েছে তা ২৫৮ কোটি টাকার। এর আগে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে প্রকল্পটির ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২২৯ কোটি টাকা। যা থেকে ১৬৫ কোটি টাকা রানিং বিল হিসেবে গ্রহণ করে এমএমডিসি নামে কোম্পানিটি কাজ বন্ধ করে এক ধরনের পলায়নপর প্রক্রিয়ায় চলে যায়। কাজে ছিল ধীরগতি ও নিম্নমানের। প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মাঝেও ছিল বেতনভাতা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ। সার্বিক দিক বিবেচনা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয়। অথচ ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। এমএমডিসির কাজ বন্ধ করে দেয় পলায়নের ঘটনায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প আতুড় ঘরেই মারা যাওয়ার মতোই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ আইনী লড়াই শেষে ড্রেজিং নিয়ে আদালতের আদেশ প্রাপ্তির পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই প্রকল্পের নাম বাদ দিয়ে নতুন ডিপিএম প্রকল্প গ্রহণ করলে তা সরকার অনুমোদন দেয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৮ কোটি টাকা। আগামী মাসে এ সংক্রান্ত টেন্ডার আহ্বানের চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে এর কার্যক্রম একটি বিশেষ সংস্থাকে দিয়ে করানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে বছরের পর বছর ড্রেজিং কার্যক্রম না হওয়ার কারণে কর্ণফুলী নদীর বিবর্ণ দশা। উজান থেকে নেমে আসা পলি ও মহানগরী থেকে অপসারিত বর্জ্যে নাব্য যেমন মারাত্মকভাবে কমে গেছে তেমনি অবৈধ দখলে এটি আগের তুলনায় ব্যাপকভাবে ছোট হয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর পানিও দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে আছে। যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামীতে চট্টগ্রাম শহর ব্যাপক জলাবদ্ধতার দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পাবে। একদিকে চাক্তাই খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে পানি যেমন কর্ণফুলী নদীতে যাওয়ার প্রবেশ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে নৌযান চলাচলেও বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়ে আছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) জাফর আলম সোমবার জনকণ্ঠকে জানান, সরকার কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং নিয়ে নতুন প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়ার পর দ্রুতগতিতে টেন্ডার আহ্বান প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এছাড়া ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া এমএমডিসির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি আরবিট্রেশনে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিষয়টি সুরাহা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
×