এম শাহজাহান ॥ জনকল্যাণে অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনতে এ খাতের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর পদক্ষেপ থাকছে নতুন বাজেটে। এছাড়া হেপাটাইটিস বি, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং ক্যান্সাসের মতো কঠিন চিকিৎসায় ব্যবহার হয় এমন সব ওষুধের দাম কমানোর আভাস পাওয়া গেছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যবহৃত কেমিক্যাল আমদানি সহজ করা হবে। এর মূল কারণ হলো সব ধরনের রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা টেস্ট ফি কমানো। বর্তমান উচ্চমূল্যের টেস্ট ফির কারণে সাধারণ ও মধ্যবিত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে চিকিৎসা ব্যয়। একই সঙ্গে রোগীদের আনা-নেয়া এবং লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সের সব ধরনের সার্ভিস ভ্যাটমুক্ত রাখার ঘোষণা আসছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জানা গেছে, চিকিৎসা ব্যয়ে বিপর্যস্ত দেশের সাধারণ মানুষ। চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। দেশের ৭৫ শতাংশ কিডনি রোগী ব্যয়বহুল কিডনি রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সমর্থ হয় না। বাংলাদেশে ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী থাকলেও সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা পায় মাত্র এক লাখ লোক। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে জনগণের অন্যান্য অত্যাবশকীয় জিনিসের ওপর চাপ পড়ছে। স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত না হওয়ায় ধনীরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।
অপরদিকে, গরিব মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা বহন করা আরও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে ভর্তি ও অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অনেক দরিদ্রই ঋণগ্রস্ত হন বা জমিজমা বিক্রি করছেন। একদিকে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে আর কাজ করতে না পারায় আয় কমে যায় তাদের। এ বাস্তবতায় আগামী বাজেটে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মানব উন্নয়ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা এগিয়ে নিতে হলে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতে। দেশে চিকিৎসা ব্যয় অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। তবে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বেশকিছু আইন ও নীতিমালা রয়েছে, যা প্রয়োগ করলে চিকিৎসা ব্যয় কমানসহ অসংক্রামক রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতে মোট ১৭ হাজার ৫১৬ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ছয় হাজার ২৩৪ কোটি টাকা এবং অনুন্নয়ন ব্যয় ১১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতে বিগত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ হয়েছিল ১৪ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তবে চলতি বাজেটে ওষুধের দাম কমানো এবং স্বাস্থ্যসেবা সহজ করার আভাস দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, দেশীয় ওষুধ উৎপাদনে যে সুযোগ সরকার করে দিয়েছে, ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তার খানিকটা অপব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, উৎপাদিত ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিও উঠেছে। আমরা এ বিষয়ে সজাগ আছি এবং প্রয়োজনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
জানা গেছে, অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার এক বছর পরও দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসা ব্যয় কমেনি। বরং ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। এছাড়া বেসরকারী খাতের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে কিন্তু তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ভুল ডায়াগনসিস এবং চিকিৎসার কারণে অকালে মারা যাচ্ছেন অনেকেই। এমনকি গ্যাস্ট্রিকের অতিপরিচিত এ্যান্টাসিড, ওমেপ্রাজল, প্রেসারের জন্য ইনডেভার-৪০, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসামান উন্নত করতে হলে উন্নত যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ আমদানির প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ওষুধ-কেমিক্যাল ভ্যাটমুক্ত হওয়া উচিত। এতে আমদানি মূল্য কমে এলে সহজে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ মিলবে। সুস্বাস্থ্যবান জাতিই দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে।
এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে ওষুধ শিল্পের উন্নয়নে ব্যবহার্য স্পেশাল টাইপ রেফ্রিজারেটর, ল্যাবরেটরি, স্ট্যাবিলিটি, হিউমিডিটি চেম্বারে মূলধনী যন্ত্রপাতির রেয়াদি সুবিধা প্রদান, শিল্পকারখানা ও যানবাহনে ব্যবহার্য গ্রিজের সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করে লুব্রিকেটিং অয়েলের শুল্ক ১৫ শতাংশে, স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে এ্যালু বটম ফয়েলের শুল্ক ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। আগামী বাজেটেও এসব সুবিধা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে শতভাগ শুল্ক মওকুফ করা হতে পারে। এছাড়া মানবিক কারণে এবং আর্থসামাজিক খাতের জন্য বেশকিছু প্রণোদনা ঘোষণা করা হতে পারে।
এদিকে, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে এ পর্যন্ত দেশে ১৩ হাজার ১২৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। দরিদ্র গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে আরও ২৩৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ক্রমে সারাদেশে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে টেলিমেডিসিন সেবা কেন্দ্র এবং ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: