স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ঘরে ফিরে যাওয়া হয়েছে। বেসিক স্ট্রাকচারে হাত দেয়া হয়নি। ফলে এ সংশোধনী অসাংবিধানিক হবে না। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপীলের বিষয়ে সোমবার চতুর্থ দিনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ এসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা লিখিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। পরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বক্তব্য উপস্থাপন করার পর আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে সুপ্রীমকোর্ট। আজ সকাল ৯টা থেকে ফের শুনানি শুরু হবে।
বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন হাইকোর্ট বাতিল করলে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও আইন সভায় উত্তাপ ছড়িয়েছিল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীলেও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেলের। সোমবার রিট আবেদনকারীর পক্ষে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিট থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত টানা শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এ মামলার। শুনানিতে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা সরকারের পক্ষে হাইকোর্টের রায়ের বিভিন্ন যুক্তি খ-ন করেন। শুনানির একপর্যায়ে হাইকোর্টের রায় উদ্ধৃত করে মুরাদ রেজা বলেন, রায়ে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যরা অধিকাংশই ব্যবসার সঙ্গে জাড়িত। নানা ধরনের কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ডও রয়েছে। এটা সঠিক নয়। মুরাদ রেজা বলেন, একজন সংসদ সদস্যের একমাত্র পরিচয় তিনি সংসদ সদস্য। তাদের কী ব্যবসা আছে বা নেই তা কোন আলোচ্য বিষয় হতে পারে না।
মুরাদ রেজা আরও বলেন, হাইকোর্ট রায়ে বলেছে, অনেক এমপিই প্রশাসনিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জড়িত। ফলে এমপিদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রাখা যাবে না। তাহলে বিচার বিভাগের ওপর চাপ আসতে পারে। এ বিষয়ে মুরাদ রেজা বলেন, একজন বিচারপতি যখন শপথ নেন, তখন তারা বলেন অনুরাগ, বিরাগ ও ভয়ভীতির উর্ধে থেকে কাজ করবেন। একজন এমপি যদি কোন বিচারককে কোন চাপ প্রয়োগ করেন, ওই বিচারক এমপির কথা শুনবেন কেন? তাহলে তো অনুরাগ-বিরাগের বিষয় সামনে এসে যায়। বিচারকের শপথ ভঙ্গ হয়।
মুরাদ রেজা বলেন, এ সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন কিছুই সংযোজন করা হয়নি। বরং সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মূল সংবিধান রচনা করেছিল গণপরিষদ। তাই মূল সংবিধানের কোন প্রভিশন চ্যালেঞ্জ করা যায় না। মুরাদ রেজা তার বক্তব্য উপস্থাপনের শেষপর্যায়ে এসে বলেন, এ সংশোধনীর মাধ্যমে ঘরে ফিরে যাওয়া হয়েছে। বেসিক স্ট্রাকচারে হাত দেয়া হয়নি। হাইকোর্ট নিজের কাঁধে বোঝা নিয়ে সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। ঘরে ফেরা অসাংবিধানিক নয়। ঘর যে প্রভিশনে ছিল, এখনও তার মধ্যেই আছে। পিলারে হাত দেয়া হয়নি বলে তার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন মুরাদ রেজা।
পরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত পড়ছেন। পরে দুপুর সোয়া ১টায় আদালত মুলতবি করে প্রধান বিচারপতি বলেন মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে পুনরায় শুনানি শুরু হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ওই রায় আসে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ৮ মে পেপারবুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এ মামলার আপীল শুনানি শুরু হয়। ৯ মে দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি হয়। এ দুদিন রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা হাইকোর্টের রায় আদালতে পড়ে শোনান। এরপর ওই দিনই আদালতে চারজন এ্যামিকাস কিউরি তাদের লিখিত মতামত জমা দেন। এ চারজন হলেন- সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এমআই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।