ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আবদুল কুদ্দুস

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের আর্তনাদ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৩ মে ২০১৭

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের আর্তনাদ

সম্প্রতি সরকারের এক আদেশে বাংলাদেশে জ্বালানি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বৃদ্ধির পরিমাণ বর্তমান দামের থেকে ২২.৭ শতাংশ বেশি। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্ব বাজারে যেহেতু জ্বালানি গ্যাসের মূল্য বাড়েনি, তাই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে জনকল্যাণবিরোধী। শুধু সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন এবং গ্যাস খাতে কর্মরত সাহেবদের বিলাসিতা করার সুযোগ তৈরি করতেই এমন সিদ্ধান্ত! গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কিভাবে আমাদের ক্ষতি করতে পারে তার একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করছি। আমাদের শরীরে গরম অনুভূত হয়ে ঘেমে যেতে থাকলে বিদ্যুতচালিত ফ্যানের বাতাস দিয়ে আমরা গা জুড়িয়ে নিই। কিন্তু এ ফ্যানের বাতাস সঠিকভাবে উপভোগ করতে চাইলে নিজের চারপাশের অন্যসব হালকা-পাতলা জিন্সি আগে থেকেই সামলে নিতে হয়। সামলে নিতে হয় নিজের শরীরে পরিহিত কাপড় চোপড়ও। অন্যথায় হালকা হবার কারণে ঐসব জিনিস উড়ে যেতে পারে। যত্রতত্র এলোমেলো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। তবে মনে রাখতে হবে সব আবর্জনা উড়ে সরে যায় না। কিছু আবর্জনা আছে তারা সবার অজান্তে নাকের ডগায় ঢুকে সর্দি জ্বর তৈরি করে। অসুখ সৃষ্টি করে। কষ্ট দেয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ আমাদের দেশে বেশি। এই শ্রেণীর মানুষ আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্বার্থের কষাঘাতে ব্যথাতুর এ মানবগোষ্ঠী একবার যদি ফুঁসে ওঠে, তাদের সে আর্তনাদ আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। সেই আন্দোলনে দেশে যে কোন ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। আরেকটি উদাহরণ, যারা উপার্জন করে না, যেমন পরিবারের উপার্জনের অক্ষম একটি শিশু উপার্জনক্ষম ভাই অথবা মা-বাবার কাছে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করে। অফিসের একজন নি¤œশ্রেণীর কর্মকর্তা/কর্মচারী মধ্যম ও উর্ধতন কর্তপক্ষের নিকট আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করে থাকতে পারে। উর্ধতন কর্মকর্তাদের আয়-রোজগার বেশি হবার কারণে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কাজেও স্বাধীন। কিন্তু মধ্যবিত্তরা? তাদের ভরণ-পোষণ খরচ নিত্যদিন বাড়লেও সে হারে আয় বাড়ে না। সমস্যা আমাদের দেশের এই স্তরের মানুষগুলোকে নিয়ে। তাই ওদের আর্তনাদকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভেবে নেবেন না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে অথবা অন্য কোন কারণে সাংসারিক খরচ বেড়ে গেলে দেশের মধ্যবিত্তদের সমস্যার সীমা থাকে না। বর্তমানে দেশে গ্যাসের মজুদ নিয়ে তেমন শঙ্কা নেই। তাই মজুদ গ্যাসের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত না করে দাম বাড়িয়ে এই খাতের সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করা সম্ভব নয়। সক্ষমতা বৃদ্ধি না করলে দাম বাড়িয়ে বেশিদিন আয় টিকিয়ে রাখা যাবে না। শুধু আইনের বলে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক হতে পারে না। মানুষ ও মানুষের জীবন আইনের অনেক ওপরে। মানুষ না থাকলে আইনের কোন মূল্য নেই। মানুষকে কষ্টে রাখে এমন আইন কল্যাণকর নয়। রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য থামিয়ে দিয়ে টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। তাছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের উন্নয়ন, মানব কল্যাণ, বিনিয়োগ ও রাজনীতিতে যে ধরনের প্রভাব পড়বে তার একটি সম্ভাব্য প্রবাহ নিচে দেয়া হলো : সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যেহেতু বিনিয়োগযোগ্য আয় হ্রাস পাচ্ছে, তাই মানব কল্যাণও হ্রাস পাচ্ছে। একপর্যায়ে সাধারণ জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শান্তি বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জ্বালানি গ্যাসের ওপর অনাকাক্সিক্ষত চাপ হ্রাসকরণে দরকার সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। দেশের সকল সেক্টরে রাজস্ব আদায় সফলভাবে সম্পাদন হলে সরকারের খরচ নির্বাহে পণ্যমূল্যের দাম বাড়াতে হবে না। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা দরকার। এ কৌশল অবশ্যই যেন জনবান্ধব হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের উপার্জিত টাকা যেন ভিন্নপথে খরচ না হয়ে দেশের উন্নয়নে ও জনতার কল্যাণে ব্যয়িত হয়, সেই বিষয়টি জোরদার করতে হবে। সামর্থ্যবানদের অতিরিক্ত টাকা সঠিকভাবে বণ্টনের জন্য বিশেষ করনীতি দরকার। এজন্য কর বৃদ্ধির জন্য কৌশল নির্ধারণ করা অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ লক্ষ্যে সরকারের কর বৃদ্ধির জন্য যে প্রতিষ্ঠান বা এর কর্মচারীরা অতিরিক্ত শ্রম দেবে তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। কর বৃদ্ধির জন্য চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা দ্বারা কর ফাঁকি দাতাদের সিন্ডিকেটে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। দ্রুত কর প্রদানের জন্য ক্যাম্পেইন করে করদাতাদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেরা করদাতাদের ঋৎরবহফং ড়ভ ইধহমষধফবংয এড়াবৎহসবহঃ উপাধি প্রদান করতে হবে এবং তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবহারের জন্য অনুমোদন থাকবে। যেদিন কোন করদাতা করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও কর প্রদানে গড়িমসি করবে তাদের কাছ থেকে এ উপাধি ছিনিয়ে নেয়া হবে। আবার মনে রাখতে হবে যে, দেশের সব এলাকার মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের আয়-রুজির ধরন এক নয়। তাই কার্যকর রাজস্ব আদায়ে দেশের সর্বস্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। একজন জনপ্রনিতিধিই জানেন তাঁর এলাকার মানুষের আয়-রোজগার কেমন। কোন কৌশলে তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় যৌক্তিক হবে। এ ছাড়াও তাঁরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার চালানোর জন্য একটি কম্প্রেহেনসিভ জবাবহঁব ঈড়ষষবপঃরড়হ ঝঃৎধঃবমু নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কৌশল তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন নিয়ে রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত হতে পারে। এটি শ্রমিক-মালিক, রাষ্ট্রীয়-অরাষ্ট্রীয় বা যে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান হতে পারে। এটি যেমন কৌশল বৃদ্ধি করবে, তেমনি জবাবহঁব বাড়াবে। প্রয়োজনে সরকারী উদ্যোগে এনবিআর এর পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে ঋড়ৎসঁষধঃরড়হ ড়ভ জবাবহঁব ঈড়ষষবপঃরড়হ ঝঃৎধঃবমু ধহফ জবংবধৎপয ঈবষষ গঠন করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সারা বছর লাভ না করে লোকসান করলে এর কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ বহাল তবিয়তে চাকরি করবার সুযোগ হারাবে মর্মে আইন পাস করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত টাকা ফেলে না রেখে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা বাড়ানোর কাজে নিয়োজিত থাকতে পারে। এর জন্য প্রয়োজনে পৃথক সেল থাকবে। পার্ক, বাগান, সরকারী জায়গা শুধু বিনোদনের জন্য ভেবে খরচ না বাড়িয়ে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এলাকাভিত্তিক জমির মূল্য ও মানুষের জীবনমান বিবেচনা করে রাজস্ব বৃদ্ধির কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচনী ইস্তেহারে উন্নয়নের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও কোন খাত থেকে কিভাবে রাজস্ব যোগান দিয়ে উন্নয়ন করা হবে, সে ধরনের কোন নির্দেশনা থাকে না। রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য কৌশল নির্ধারণপূর্বক তা নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রচার করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কথা ভেবে তাদের কথায় কর্ণপাত করে মানবতার কল্যাণে সরকারকে কাজ করতে হবে। মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগলে মানুষ আর সাধারণ মানুষ থাকে না। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। বর্তমান সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অনেক অর্জন রয়েছে। দু’একজন মন্ত্রী-আমলার দূরদর্শিতার অভাবে যেন সকল অর্জন নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কৌশল নিধারণ করে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করে নয়, বরং সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করে সক্ষমতা অর্জনই হতে পারে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম পথ। সরকারী কর্তৃপক্ষ চাইলে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ সর্বদাই একসঙ্গে কাজ করবার প্রত্যয়ে এগিয়ে আসবে। লেখক : শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
×