ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর

পরিবেশবান্ধব পাটের পলিথিন

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৩ মে ২০১৭

পরিবেশবান্ধব পাটের পলিথিন

যতই ব্যস্ততার মধ্যে থাকি না কেন সপ্তাহে অন্তত একবার নিজের হাতে বাজার করতে বের হই। সেই বাজার করতে এ সপ্তাহে শুক্রবারের ছুটির দিনেও বেরিয়েছিলাম। বাজারের কয়েকটি অংশ থাকে যা আমরা সবাই জানি। যেমন শাকসবজির কাঁচা বাজার; মাছ, মাংসের ভেজা বাজার; চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, মসলাসহ অন্যান্য শুকনা বাজার ইত্যাদি। এভাবে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে দেখলাম যে, আমার বাজারের আইটেম মোট ১৫টি। সেই ১৫টি আইটেমের বাজার করতে গিয়ে দেখলাম, প্রতিটি বাজারের আইটেমের জন্য আকার-আকৃতি অনুসারে একটি করে পলিথিন ব্যাগ দিয়েছে। সেই ১৫টি ছোট ছোট ব্যাগের বহরটি আবার আরেকটি বড় পলিথিনের মধ্যে ঢুকিয়ে বাজারগুলো গছিয়ে দিয়েছে। তাহলে মোট পলিথিনের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬টিতে। আমি বাজার করার জন্য যথরীতি একটি বড় পাটের বস্তার ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রত্যেকটি আইটেম দেওয়ার সময় কোন পলিথিন না দেওয়ার কথা বললেও দোকানিরা তা শোনেনি। তাদের বজারের আইটেম মেপে দেওয়ার সুবিধার্থেই নাকি এ কাজ করতে হয় বলে জানালেন অনেকে। আবার কেউ কেউ কোন কোন আইটেম আগে থেকেই নির্ধারিত পরিমাণ মেপে মেপে কাস্টমারের জন্য পলিথিনের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে দেয়। সেটাও তো পলিথিন, নিতে সকলে বাধ্য। এরকম কাজ যে শুধু শহরেই হচ্ছে তা নয়, গ্রাম-গ্রামান্তরের প্রত্যেকটি বাজার দোকানে একই অবস্থা। বাজার করে বাসায় নিয়ে আসার পর সেগুলো একটির পর একটি খুলে খুলে একসঙ্গে জমিয়ে পাশের কোন ডাস্টবিন কিংবা ফাঁকা স্থানে ফেলে দিয়ে আসে। তারপরে কোথায় যায় সেই পলিথিনগুলো? এভাবে প্রতিদিন শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ, কোটি কোটি পলিথিন জমা হচ্ছে ভূ-উপরিভাগে। তারপর সেগুলো আবার বাতাস, বৃষ্টির পানির স্রোত, বন্যা ইত্যাদির মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। আর সেভাবে ভূপৃষ্ঠময় একটি পলিথিনের স্তর জমে গেছে। পলিথিন একটি অপচনশীল দ্রব্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে এটি প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর অপচনশীল অবস্থায় অবিকৃত থাকে। মাটিতে কিংবা পানিতে একটি পলিথিন পড়ার পর তা এত দীর্ঘদিন অবিকৃত থাকার কারণে তা পরিবেশের জন্য নানারকম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে। পলিথিন কতভাবে যে মানুষ, জীবন্ত অন্যান্য উদ্ভিদ, প্রাণীকুল এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে, তা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। তারপরও উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় অলোচনা না করলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে না। দীর্ঘদিন যাবত পলিথিনের ব্যবহার হওয়ায় এখন কৃষি জমির উপরিস্তর পলিথিনে ছেয়ে গেছে। সেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পলিথিনের স্তর জমে রয়েছে। এতে আধুনিক কৃষিকাজের অনেক সমস্যা হচ্ছে। সেখানে চাষ দেওয়া, ফসল আবাদ করা, ফসলের আবাদজনিত আন্তঃপরিচর্যা করা, সেচকার্য করা ইত্যাদি প্রতিটি কাজে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। জমিতে সার, কীটনাশক, সেচের পানি দিলে সহজে তা নিষ্কাশিত হয় না। পানি প্রয়োজনের তুলনায় বেশিদিন মাটিতে আটকে থাকছে। সেখানে ফসলের গাছগুলোর শিকড় মাটির গভীরে যেতে পারছে না। সেজন্য গাছও মাটির গভীর থেকে পানি এবং প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যগুলো গ্রহণ করতে পারছে না। আমরা জানি, কোন স্থানের পরিবেশ সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হলে সেখানকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাটা সঠিকভাবে করতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে বিভিন্ন জায়গায় পানির পরিচলনের পথগুলো যেমন, ছোট-বড় ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে থাকছে পলিথিন জমা হয়ে। সেভাবে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ইত্যাদির পানির ¯্রােতধারা পর্যন্ত বন্ধ কিংবা গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে এ পলিথিনের কারণে। আর এসব পানির পরিচলনের মাধ্যমে পলিথিনের স্রোতধারা সাগর মহাসাগরে গিয়ে জমা হয়ে কয়েক ফুট পলিথিনের একটি স্তর সৃষ্টি করেছে বলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি সত্যিই একটি ভয়াবহ বিপর্যয়। এতে নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি স্থানে মাছের একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কারণ এসব পলিথিনের জন্য মাছ তার প্রয়োজনমতো খাদ্য ও শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না। যেজন্য এসব জলাশয়ে মাছের বংশবৃদ্ধি ও আকার-আকৃতি সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, গ্রামে বা শহরাঞ্চলে কিছু গবাদিপশু (গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি) প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে ছেড়ে রাখতে দেখা যায়। এলাকাময় এখানে ওখানে ঘাস খেয়ে তাদের জীবন নির্বাহ করে। কিন্তু আমার আশপাশে এরকম দুয়েকটি ঘটনা দেখেছি যেখানে সেই গবাদি পশুগুলো হঠাৎ মারা গেছে। কারণ তারা মাঠে, রাস্তা ঘাটে ঘাস খাওয়ার সময় তার সঙ্গে ছোট-বড় অনেক পলিথিনের টুকরা অজান্তেই খেয়ে ফেলেছে। এভাবে খেতে খেতে তা পেটের ভিতরে আস্তে আস্তে জমে গেছে। ফলে সেগুলোর চাপে এবং প্রতিক্রিয়ায় পেট খারাপ করে সেই পশুগুলো মারা গেছে। কোরবানির জন্য হাট থেকে যেসব পশু কিনে আনা হয়, সেগুলো জবাই করার পর তাদের পাকস্থলীতে অনেক পলিথিন আটকে থাকতে দেখা যায়। কোথা থেকে আছে এসব পলিথিন? এক কথায় সহজ উত্তর হলো আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করছি এসব পলিথিন, ব্যবহার করছি এসব পলিথিন এবং যত্রতত্র ফেলছি এসব পলিথিন, যার কোন ক্ষয় বা বিনাশ নেই। এভাবে আর কতদিন চলবে? কী হবে ভবিষ্যতে? এসব বিষয় চিন্তা করলে সামনে অন্ধকার দেখা যাওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। পলিথিনকে যদি পুরোপুরি রিসাইক্লিং করা যেত তাহলে হয়ত এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো। কিন্তু বর্তমানে সর্বোচ্চ ২০% পর্যন্ত রিসাইক্লিং করা সম্ভব হয়। আর বাকি পলিথিন চলে যায় পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য। কারণ আমরা জানি পরিবেশ ঠিক রাখতে হলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জিনিসগুলোকে তিনটি আরের (থ্রি-আর) মাধ্যমে মিনিমাইজ করা সম্ভব হতো। এখানে থ্রি-আর হলো- রিডিউস, রিইউজ এ্যান্ড রিসাইকেল। এর মাধ্যমেই পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব। পলিথিনের ক্ষেত্রে সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই যত বিপত্তি। আশার কথা, এরই মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাট মন্ত্রণালয় নিয়ে এসেছে একটি সুখবর। আর সেটি হচ্ছে গতানুগতিক ধারার ক্ষতিকর সিনথেটিক রাসায়নিক পলিথিনের পরিবর্তে পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব পলিথিন। এ পলিথিন তিন থেকে সর্বোচ্চ ছয়মাসের মধ্যে মাটির সঙ্গে পচে মিশে যাবে। এটি যে পলিথিনের জগতে কী এক বিরাট সফলতার খবর, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কারণ আমরা জানি এখন পলিথিনের ব্যবহার এত ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে, যা আর কোন অবস্থাতেই একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়, বড়জোড় একটু আধটু কমানো যেতে পারে। এরই মাঝে মে ২০১৭ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার ডেমরার লতিফ বাওয়ানি জুটমিলে পাট থেকে পলিথিন উৎপাদনের এ সংবাদটি জাতির সামনে তুলে ধরে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বক্তব্য রাখেন। সেখানে পাট ও পাটজাত বর্জ্য হতে পলিব্যাগের সেলুলোজ নিয়ে তার সঙ্গে কেমোসিনথেটিক মিলিয়ে তা অল্প আঁচে গলিয়ে ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পলিথিন। প্রতিষ্ঠানটি একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে এ অসাধ্য সাধন করার খবরটি প্রকাশ করেছে। প্রচলিত পলিথিনের মতই এ পলিথিন। এটা হালকা, পাতলা, টেকসই ও দামে সাশ্রয়ী হবে। এটি মাত্র দুই হতে তিন মাসেই মাটিতে মিশে যাবে। বাংলাদেশে পাটের তৈরি এ পলিথিন উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোবারক আহমদ। এর আগে পাটের সুদিন আবার ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবে আরও কয়েকটি অসাধ্য সাধিত হয়েছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের দ্বারা। এর অন্যতম একজন ছিলেন ড. মাকসুদুল আলম যিনি পাটের জীবনরহস্য ও এর ক্ষতিকর রোগজীবাণু হিসেবে একটি ছত্রাকের জীবনরহস্য অবিষ্কার করেছিলেন। পলিথিন নিঃসন্দেহে পরিবেশের একটি শত্রু। বিজ্ঞানীদের মতে পলিথিন প্রকৃতি থেকে প্রায় সাড়ে চারশ’ বছরের বেশি সময়েও মাটিতে মিশে যায় না। সূর্যের তাপ, আবহাওয়া, আর্দ্রতা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এদের কোনটিই পলিথিনকে নষ্ট করতে পারে না। এ ছাড়া আগেই বলেছি, মাত্র ২০% শতাংশ ব্যাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য আর ৮০ শতাংশই প্রকৃতিতে বিরাজমান থেকে যায়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটা ক্যান্সার ও চর্মরোগের অন্যতম কারণ। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বে প্রতিবছর এক মিলিয়নেরও বেশি পাখি ও লক্ষাধিক জলজ প্রাণী ধ্বংসের কারণ পলিথিনের ব্যবহার। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী দেখিয়েছে, শুধুমাত্র ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহৃত হয়। আর বুড়িগঙ্গা নদীতে রয়েছে ৫-৬ ফুট দীর্ঘ পলিথিনের স্তর। এগুলোর জন্যই জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খল বিনষ্ট করে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে পড়ছে। ঠিক এমন একটি সময়ে পাট হতে পলিথিন উৎপাদন বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। এটি বর্তমানে যে শুধু আমাদের দেশের একক কোন সমস্যা, তা নয়। সেজন্য যখন পাট হতে পরিবেশবান্ধব এ পলিথিনটি আবিষ্কারের ঘোষণাটি আসল, তখন জনমনে বিরাট আশাার অলো সঞ্চারিত হয়েছে। এতে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। একটি হলো পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিনের উৎপাদন হ্রাস পাবে। অপরদিকে পাটের সুদিনের পালে আরও একধাপ হাওয়া লাগার সুযোগ সৃষ্টি হলো। কারণ আমরা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ শতকরা ১০ শতাংশ পাট ব্যবহার করতে পারি। বাকি পাট বিদেশে রফতানির ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে হয়। তাছাড়া সেই রফতানিকৃত পাটের পুরোটাই আবার কাঁচা পাট। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ক্ষেত্রে পুরো উল্টো চিত্র চোখে পড়ে। কারণ তারা মাত্র ৫-১০% পাট ও পাটপণ্য রফতানি করার বিষয়ে চিন্তা করে বাকি পুরোটাই নিজস্ব কাজে ব্যবহার করে। সেই রফতানি আবার কোনটাই কাঁচা পাট হিসেবে রফতানি করে না। সেটা প্রসেস করে রফতানি করে। শুধু তাই নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে যে কাঁচা পাট আমদানি করে, তা প্রসেস করে আবার অন্যদেশে রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পাট আমদানির ক্ষেত্রে তারা যে এ্যান্টি ডাস্পিং করারোপ করেছে, তাতে সেখানে আর তেমনভাবে রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় পাটের পলিথিন উৎপাদনের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে একদিকে যেমন পরিবেশ ঠিক করতে হবে, অপরদিকে প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি করে বিদেশে বাংলাদেশের পাট পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে এ কৃষি পণ্যটির ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল করা সম্ভব। লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ [email protected]
×