ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্যিকীর কবলে এখন বাঙালীর আম দুধ উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২০ মে ২০১৭

বাণিজ্যিকীর কবলে এখন বাঙালীর আম দুধ উৎসব

বাঙালীর মধুমাস জ্যৈষ্ঠ এসে গেছে। এ মাসে হরেক ফলের সমারোহ ঘটে। যথারীতি গাছে গাছে পাক ধরতে শুরু করেছে আম, জাম-লিচুসহ হাজারো ফল। মধুমাসের শুরুতেই রাজশাহী অঞ্চলের বাজারে এসেছে অনন্য রসালো লিচু। কোথাও কোথাও সীমিত আকারে উঠেছে আম। বছরের এই সময়ে এ অঞ্চলে নতুন ধান কেটে শুকিয়ে গোলায় তুলছে কৃষক। এরই মধ্যে বাগানে বাগানে গাঢ় সবুজ আমের শরীরে সিঁদুরের রং ধরতে শুরু করেছে। সবকিছু মনে করিয়ে দেয়, এটি মধুমাস। বাহারি আর পুষ্টিকর সব ফলের প্রাচুর্য এই সময়টিকে দিয়েছে মধুমাসের মহিমা। আম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুল, তরমুজ, পেয়ারাসহ নানা বাহারি ফলের স্বাদ আর রঙের ছোঁয়ায় বাঙালীর রসনা তৃপ্ত হয় এ মাসে। উৎসবের প্রস্তুতি চলছে ঘরে ঘরে। আর ক’দিন পরেই শুরু হবে মধুমাসের ফল উৎসব। আমন্ত্রণ জানানো হবে জামাই-মেয়েকে। নতুন জামাইয়ের বাড়িতেও যাবে আম, কাঁঠাল, লিচুর উপহার। গ্রামবাংলায় ঋতু বদলের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ, গন্ধ অনুভব ও পরিতৃপ্ত করে আমাদের। ষড়ঋতুর মধ্যে একটি গ্রীষ্মকাল নিয়ে আসে সুমিষ্ট ফলফলাদি। বিশেষ করে আম প্রধান রাজশাহী অঞ্চলের ঘরে ঘরে আমের গন্ধে ভরে থাকে এই মাস। মধুমাসের মধুরসে মুখরিত থাকে সব পাড়া। পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন হলেও পুরনো রীতিনীতি এখনো থেকে গেছে। জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই গ্রামের ঘরে ঘরে অতিথি বরণের রেওয়াজ দেখা যায়। যুগযুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। নিকটাত্মীয়দের ফল দিয়ে আপ্যায়ন করার পালা শুরু হয় এ মাসে। পুরো মাসজুড়েই মেয়ে-জামাই আর নিকটাত্মীয়দের আনাগোনায় মুখরিত থাকে গৃহস্থের ঘরদোর। বছরের এ সময় মধুরসের সঙ্গে আলাদা আনন্দের ঢেউ বয়ে যায় রাজশাহী অঞ্চলে। নতুন ধান কাটা-মাড়াই করার ফাঁকে ফল উৎসবে মেতে ওঠে মানুষ। আত্মীয়ের বাড়ি যেতে কিংবা অতিথি আপ্যায়নে তাই এ সময় অন্যান্য খাবারের সঙ্গে যুক্ত হয় নানা স্বাদের ফল। বিশেষ করে আম-লিচু ও কাঁঠালসহ সব রকমের ফলের নমুনা দিয়ে আপ্যায়ন করার রীতি হাজার বছরের। যদিও দুর্মূল্যের এই বাজারে ফল নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যেতে চায়। কিন্তু আজও গ্রামবাংলায় বাড়ির উঠানের একচিলতে জায়গায় একটি-দুটি আম-কাঁঠাল গাছের দেখা পাওয়া যায়। রাজশাহী হলো আমের দেশ। তাই জ্যৈষ্ঠে বিভিন্ন জাতের আমের ছড়াছড়ি রাজশাহীজুড়ে বিদ্যমান থাকে। এই সময়ে বাহারি রঙের ফলে ছেয়ে যায় বাজার। গ্রামের চেয়ে এখন শহরের বিভিন্ন জায়গায় দোকানি ফলের দোকান সাজিয়ে বসে। দূর-দূরান্ত থেকে এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে মধুমাসের নানা জাতের ফল। রসে টইটম্বুর মওসুমী ফলের ঘ্রাণে ক্রমেই ভরে ওঠে প্রাণ। আবহমান বাংলার অনেক ঐহিত্য রয়েছে মধুমাসকে ঘিরে। বাবা রসাল ফল হাতে মেয়েকে আনতে যায় তার শ্বশুরবাড়ি। ফল দিয়ে মেয়ে-জামাই এবং পরিবারের অন্যদের দাওয়াত দিয়ে আসে। জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাই না এলে মধুমাসই পরিপূর্ণ হয় না। মেয়ের জামাই বেড়াতে এলে আম-দুধ, কাঁঠাল আরও কত কী খেতে দেয়। ঝড় হোক আর রোদে মাঠঘাঠ শুকিয়ে যাক, আম-কাঁঠাল নিয়ে মেয়ে বাড়ি যেতেই হবে। এরসঙ্গে গ্রামের সম্মানও জড়িয়ে থাকে। গ্রামের লোকজনের নিজেদের গাছ থাকায় খুব কমই ফলমূল কিনে খেতে হয়। তারপরও যাদের নেই তারাও থেমে থাকে না। বাজার থেকে কিনে এনে পরিবারের রসনা মেটায়। এ সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। কোথাও কোথাও মওসুমী ফলের মেলাও বসে। আম ও লিচু সমৃদ্ধ রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা উপজেলা। বাঘার বাউশা এলাকার সুলতানুল হক জানান, এ মাস তো আম-কাঁঠাল আর লিচুর মাস। গাছে আম পাকা শুরু হলেই দূরের স্বজনদের ডাকা হবে। তাদের বাড়িতেও পাঠানো হবে আমের উপহার। তিনি জানান, কেবল আমে পাক ধরেছে। আর ক’দিন পরেই পাড়া শুরু হবে। তখন ঘরে ঘরে চলবে উৎসব। এরই মধ্যে লিচু উঠে গেছে। অনেক বাড়িতে লিচু উপহারও পাঠিয়েছেন ইতোমধ্যে। সবশেষে পাকবে কাঁঠাল। ওই সময়ও আবার শুরু হবে আলাদা উৎসব। শুধু সুলতানুল নয়, তার মতো গৃহস্থরা বাজারে আম বিক্রির পাশাপাশি আম দিয়ে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকে। অনেকের ঘরে ঘরে এখন থেকেই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। অনেকে গাছের প্রথম পাড়া আম লিচু মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এখন এ রীতিও বদলে যাচ্ছে। বাণিজ্যিকীকরণের কারণে ফল উৎসব অনেকটাই অতীত হয়ে যাচ্ছে। এখন আম আর লিচু ঘরে খাওয়ার চেয়ে বিক্রির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সব বাড়িতে আর এমন অতিথি আপ্যায়নের হিড়িক চোখে পড়ে না। Ñমামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×