ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবি ফজলুল হক হলের পুনর্মিলনী ও প্রথম সাধারণ সভা

নবীন-প্রবীণের গল্প আড্ডায় মুখরিত কার্জন হলের সবুজ প্রাঙ্গণ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২০ মে ২০১৭

নবীন-প্রবীণের গল্প আড্ডায় মুখরিত কার্জন হলের সবুজ প্রাঙ্গণ

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ শত কর্মব্যস্ততা ভুলে দেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে থাকা পুরনো সোনালি দিনের স্মৃতি রোমন্থনে পুরো একটি দিন অতিবাহিত করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। সহপাঠীদের সঙ্গে মাতলেন গল্প, আড্ডা, গান আর সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে। শুক্রবার দিনব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সবুজ প্রাঙ্গণে স্মৃতির টানে মুখরিত হয় হাজারো নবীন-প্রবীণ ঐতিহাসিক হল জীবনের পুরনো সোনালি দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক হলের এই পুনর্মিলনী ও প্রথম সাধারণ সভায় ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চেীধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হোসেন মনসুর প্রমুখ। কামাল আবদুল নাসের চেীধুরী স্মৃতি চারণ করে বলেন, স্মৃতি আত্মজীবনেরই অংশ। আমদের কিছুই হারিয়ে যায়নি। আমাদের স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে। অসাধারণ প্রতিবাদের সময় ফজলুল হক হলের সেই দিনগুলো। সেই সময় হলে বসে রাত জেগে জেগে অনেক প্রতিবাদী কবিতা লিখেছিলাম। ছাত্রলীগের বর্তমান যে সঙ্গীত ‘শিক্ষা শান্তি প্রগতির নামে মোরা মুজিবের সৈনিক’ সে সঙ্গীত ফজলুল হকে হলে বসে লিখেছিলাম। সেই সময়টা ছিল আমাদের সৃজনশীলতার সময়। আমরা ডাকসু রাজনীতি করতাম। তিনি আরও বলেন, আজকে যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে আমরা দাঁড়িয়েছি সেই অগ্রযাত্রার সবারই শামিল হতে হবে। শুধু অতীত রোমন্থন করার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। সারা দেশকে বদলে দেয়ার যে রূপকল্প হাতে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়নে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। এইচটি ইমাম বলেন, তখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির দারুণ চর্চা হতো। আনন্দ, খেলাধুলা আর পড়াশোনা একসঙ্গে চলত। সেই সময় ডাকসু নির্বাচন হতো এবং ডাকসু ছিল খুব শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু এই হলে আসতেন ও সভা-সমিতি করতেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমানও ছিলেন এই হলের শিক্ষার্থী। তাদের জন্য আমরা ধন্য। তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন করাচী গিয়েছিলাম স্কলারশিপ নিয়ে। সেটা আমাদের অনেক বেশি উৎসাহিত করেছিল। তখন আমরা করাচী বিশ^বিদ্যালয়ে বসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তখন আমরা যেই সুযোগ, সুবিধা ও সহানুভূতি পেয়েছি সেটি স্মরণীয়। সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। কেএম নুরুল হুদা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর পরই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে নতুন একটা চেতনা ও একটি সংগ্রামী মনোভাব জাগ্রত হয়েছিল। তারপরে ধারাবাহিকভাবে অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ ও নির্যাতন হয়েছে ছাত্রদের ওপর। তখন ফজলুল হক হলসহ সব হলের সামনে ইপিআর বাহিনী অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিত যেন শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করতে না পারে। স্বাধীনতার জন্য সব আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তাই হল জীবনের প্রতি আমরা অত্যন্ত দুর্বল। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, হলের জীবন খুবই সুখময় ও সোনালি। হলের স্মৃতি সবচেয়ে সুন্দর ও সোনালি স্মৃতি। আমাদের অতীত ইতিহাস ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেই অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, অত্যন্ত কঠিন সময়ে আমাদের পদযাত্রা শুরু হয়েছিল। কারণ, সে সময় আমরা পরাধীন ছিলাম। কি উত্তাল সময় আমরা কাটিয়েছি। সেই সময়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। সেসব কথা আজও খুব মনে পড়ছে। নিজ বন্ধুর গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার বন্ধু নজরুলের কথা খুব মনে পড়ছে। মার্চে যখন বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন তখন ফজলুল হক হলে গঠন করা হয়েছিল সূর্যসেন স্কোয়াড যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য। সেই স্কোয়াডের সদস্য ছিলেন নজরুল। সব সময় সে মিছিলের সামনে থাকত। যখন ২ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হলো তখন সেই মিছিলে স্বাধীন বাংলার পতাকাটি ছিল নজরুলের হাতে। নজরুল এখন আর নেই। ১৯৭১ সালে ট্রেনিং শেষ করে যখন ফিরে আসছিলেন তখন পাকবাহিনীর হাতে অনেক বিস্ফোরকসহ ধরা পড়ে। পাকিস্তানীরা তাকে বেঁধে সেই বিস্ফোরক তার শরীরে ব্যবহার করে। নজরুলের মাংস, রক্ত, শরীর, আত্মা বাংলার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আজকে তাকে খুবই স্মরণ করছি। তিনি বলেন, সেই সময়ের বা তার আগের অনেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়েছে। আমরা সেই মধুর স্মৃতিগুলো ধরে রাখব। তিনি আরও বলেন, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এই হলের শিক্ষার্থীরা। কারণ, সেই সময় ছাত্র রাজনীতিতে মেধাবীরা ছিল। আর ছিল ছাত্র সংসদ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পথ দেখাতে ডাকসু নির্বাচন খুব দরকার। তার মধ্যে থেকে ছাত্র নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। আমরা যেন সেই ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারি। ক্ষোভ প্রকাশ করে এ সময় তিনি বলেন, কোথায় গেল সেই রাজনীতি? কোথায় গেল সেই ছাত্র সংসদ? কোথায় গেল সেই নির্বাচন? নির্বাচন আছে শিক্ষকদের জন্য। নির্বাচন আছে কর্মচারীদের জন্য। নির্বাচন নেই ছাত্রছাত্রীদের জন্য। এর থেকে পরিহাসের কথা আর কি হতে পারে? আজকে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশের হাল ধরতে হবে মেধাবীদের। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানসহ সব সময় এই হল থেকে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য হলের শিক্ষার্থীদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। অনুষ্ঠানে আরও অংশ নেন হলের সাবেক শিক্ষার্থী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক হল প্রাধ্যক্ষ আবু জাফর মোহাম্মদ, হল প্রভোস্ট অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কবির বিন আনোয়ার।
×