ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজীবন ভাড়া পরিশোধ করতে হবে

বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটারের দায় গ্রাহকের ঘাড়ে

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ মে ২০১৭

বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটারের দায় গ্রাহকের ঘাড়ে

রশিদ মামুন ॥ সারাদেশের সকল গ্রাহককে পাঁচ বছরের মধ্যে বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল বিদ্যুত বিভাগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন বাস্তবায়ন অগ্রগতি নেই। বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজস্ব উদ্যোগে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও এসব প্রকল্প ধীরেই চলছে। তবে এর মধ্যেই প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দায় গ্রাহকের ঘাড়ে চাপাতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুত বিভাগ। প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে অর্থায়ন জটিলতা অনেকদিনের। বিশেষ করে কোন দাতা সংস্থাই প্রি-পেইড মিটারের জন্য ঋণ দিতে চাইছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। এমনকি বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রিজার্ভ থেকে সহজশর্তে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানায়। তবে সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে প্রি-পেইড মিটারের জন্য ঋণ দিলে সেই অর্থ ফেরত নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে মনে করছে দাতা সংস্থা এবং ব্যাণিজ্যিক ব্যাংক। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করলে বিদ্যুতের রিডিং গ্রহণ থেকে বিল প্রস্তুত এবং বিল আদায়ে কোন ঝামেলা থাকবে না বিতরণ কোম্পানির। গ্রাহক বিদ্যুত বিল দেয়ার পরেই বিদ্যুত ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ শতভাগ বিদ্যুত বিল আদায় হবে। এতে গ্রাহকের সুবিধার চেয়ে বিতরণ কোম্পানির সুবিধা বেশি। সঙ্গত কারণে আশা করা হয়েছিল বিতরণ কোম্পানি কোন না কোন পদ্ধতিতে প্রি-পেইড মিটারে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু বিনিয়োগে পিছিয়ে গেছে বিতরণ কোম্পানি। এখন এসে উল্টো মিটার ভাড়া দিয়ে বিকল্প আয়ের খাতা খুলতে চাইছে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি। সম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগের জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিতরণ কোম্পানি প্রি-পেইড মিটার গ্রাহকের আঙ্গিনায় ভাড়া হিসেবে স্থাপন করবে। এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে যারা প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করছেন তাদের কাছ থেকেও এই ভাড়া আদায় করবে বিতরণ কোম্পানি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মিটার স্থাপনের সময় গ্রাহকের কাছ থেকে কোন টাকা নেয়া হবে না। কিন্তু সিঙ্গেল ফেজ মিটারের ক্ষেত্রে মাসিক ৪০ টাকা আর তিন ফেজ মিটারের ক্ষেত্রে মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। যে ভাড়া বিদ্যুত বিলের সঙ্গে আদায় করা হবে। গ্রাহক মাসের শুরুতে যখন প্রি-পেইড মিটারের জন্য কার্ড কিনবে তখনই এই ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। আর যতকাল বিদ্যুত সংযোগ থাকবে ততকালই মিটারের ভাড়া দিতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যুতের মিটার সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের চেয়েও ভাড়া প্রথায় উঠে আসবে বিপুল অর্থ। পিডিবির সব শেষ দরপত্র অনুযায়ী এক ফেজ প্রি-পেইড মিটারের দাম পড়েছে দুই হাজার ৪০০ টাকা থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা (৩০ থেকে ৪২ মার্কিন ডলার)। আর তিন ফেজ মিটারে দাম হবে ১৫ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১৯ হাজার ২০০ টাকা (১৯০ থেকে ২৪১ ডলার)। এই মূল্যের একটি মিটার স্থাপন করে আজীবন ভাড়া পরিশোধ কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গড়ে একটি প্রি-পেইড মিটারে ভাড়া হিসেবে এই অর্থ দেয়া হলে এক ফেজে ৫ বছর এবং তিন ফেজে ৬ বছরে অর্থ পরিশোধ হয়ে যাওয়ার কথা। এর একটি প্রি-পেইড মিটারের আয়ুষ্কাল গড়ে ১৫ বছর। তবে এই প্রজ্ঞাপনের শেষাংশে লেখা রয়েছেÑকোন গ্রাহক নিজেই নির্দিষ্ট ব্রান্ডের মিটার কিনে প্রতিস্থাপন করলে ভাড়া প্রযোজ্য হবে না। তবে এক্ষেত্রে মিটার সংরক্ষণের দায় গ্রাহকের কাঁধে বর্তাবে। এর অর্থ হচ্ছে মিটার রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলে প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে ভাড়া আদায় পদ্ধতি যায়েজ করা হচ্ছে। অন্যদিকে এখন একটি ডিজিটাল মিটারে মাসিক ভাড়া ১০ থেকে ২০ টাকা। এই ব্যয় কিভাবে চার থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিকল্পনা বলছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ সালের মধ্যে পিডিবির ৪৪ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৫ গ্রাহক প্রি-পেইড মিটার পাবেন। একই সময়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) গ্রাহকদের মধ্যে এক কোটি ১০ লাখকে প্রি-পেইড মিটার দেবে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ২৮ লাখ ৩২ হাজার ৮৮৪, ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ১৩ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ১৩ লাখ ৩১ হাজার প্রিপেইড মিটার বসাবে। সব মিলিয়ে মিটার স্থাপনের জন্য ১৭টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিতরণ সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের পাশাপাশি, দাতাদের ঋণ এবং টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সের মাধ্যমে এসব মিটার স্থাপন করা হচ্ছে। অধিকাংশ মিটারই চীন থেকে কেনা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ভবিষ্যতে বিদ্যুত বিতরণের শতভাগ প্রি -পেইড মিটারে হবে। এর অর্থ হচ্ছে কোটি কোটি ইউনিট বিদ্যুতের মিটার বিক্রি হবে। সঙ্গত কারণে এই ব্যবসার ভবিষ্যত বিবেচনা করে একটি সিন্ডিকেট প্রি-পেইড মিটার সরবরাহে নিজেদের কোম্পানির প্রভাব বিস্তার করেছে। সাধারণত এই সিন্ডিকেটের হোতারা বিদেশী কোম্পানির দূতিয়ালি করে থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এসব মিটারের বাজার উন্মুক্ত হলে আরও কম দরে মিটার পাওয়া যেত।
×