ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১৯ মে ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) আলেলুইয়া হিন্দুস্তানে মসলিন আর মসলা বাণিজ্যের সূত্রে হাজার বছর ধরে আসা-যাওয়া করছে আর্মেনিয়ানরা। তুরস্ক, পারস্য, আফগানিস্তান, তিব্বত, চীন পর্যন্ত ছিল তাদের বাণিজ্য গতিবিধি। ঠিক তেমন এক আর্মেনিয়ান বণিকের সঙ্গে কাশ্মীরে দেখা হয়ে গেলো সম্রাট আকবরের। নাম তাঁর জ্যাকব। দেখা মাত্র পছন্দ করে ফেললেন জ্যাকবের পরিবারকে। এমন মানুষই তো হিন্দুস্তানে প্রয়োজন! আকবর আমন্ত্রণ জানালেন সারা দুনিয়া না ঘুরে আগ্রায় স্থায়ী হতে। সঙ্গে অনুমতি দিলেন তাদের নিজস্ব চার্চ স্থাপনার। খ্রীস্টান ধর্ম ছাড়া তো দ্বীন-এ-এলাহী প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! পরবর্তীতে জ্যাকবের আর্মেনিয়ান অনুসারীরা গোয়া, লাহোর, কাবুল, দিল্লী, কলকাতা, ঢাকায় ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়লেন। আকবরের মহানুভবতায় আর্মেনিয়ানরা রোমান সম্রাটের সঙ্গে তুলনা করে উপাধি দিলেন ‘ভারতের মার্কাস ওরিলিয়াস’। আকবরের দ্বিতীয় ছেলে মীর্জা দানিয়েল মহান পিতাকে সন্তুষ্ট করতে সপরিবারে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হলেন। দানিয়েলের তিন পুত্রের নতুন নামকরণ হলো যথাক্রমে ডন ফিলিপ, ডন কার্লোস ও ডন হেনরিক। তবে চার বছর পর তাঁরা আবার স্বধর্মে ফিরে এসেছিলেন বলে শোনা যায়। তবে এটা ঠিক জাহাঙ্গীরের আমলেও আগ্রার খ্রীস্টান সম্প্রদায় আরও মনোযোগ আকর্ষণ করল মুঘল রাজ পরিবারের। সেই সঙ্গে নৌ ও স্থলপথে দলে দলে ব্রিটেন, হল্যাণ্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, জর্জিয়া, উজবেকিস্তান আর রাশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার বণিকদের পাশাপাশি ভাগ্যন্বেষণে মানুষজন আসতে থাকলো হিন্দুস্তানের ঐশ্বর্যের সৌন্দর্য দেখতে। সিংহাসনে বসার পর আগ্রা’র এই ছোট চার্চটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনঃপূত হয়নি। হাজার রতœ দান করলেন চার্চের শোভা বাড়াতে। চার্চের পাদ্রীদের জন্য মাসিক বরাদ্দ হলো পঞ্চাশ হতে একশো মুদ্রা। শুধু তাই নয় জাহাঙ্গীর নিজে মাঝে মাঝে বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দিতেন। তারপরও খ্রীস্টান পাদ্রীদের মনে সুপ্ত আশা ছিল কোন না কোন দিন সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রভু যীশুকে একমাত্র আশ্রয় হিসেবে মেনে নেবেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর সযতেœ তাদের আহ্বান এড়িয়ে চলতেন। একবার তিনি আকবরী চাঈচের প্রধান পাদ্রীকে জানিয়েছিলেন, -আগুন লাগালে যদি আপনাদের কাঠের ক্রুশ আর যীশুর ছবি না পোড়ে, তবে আমি চিন্তা করে দেখতে পারি।’ ওদিকে কট্টর সুন্নীদের তখনো সাহস হয়নি মুখ ফুটে কিছু বলবে ‘পাগলা’ সম্রাট’কে। সেই ১৫৬২ সালে বানানো চার্চটির কাঁসার ঘণ্টাটা খুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। হিন্দু-মুসলমান উভয় প্রজারা লিখিত অভিযোগ করেছেন। সব সহ্য করা যায়, কিন্তু চার্চের ঘণ্টা অসহ্য লাগছে তাদের কানে। দলে দলে সবাই খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। মুঘল রতœভাণ্ডারের গুণ-মান দেখভাল করতেন ইতালিয়ান রতœকর হোর্তেঞ্জিও ব্রনজিনো। জুল কারনাইনকে সঙ্গে নিয়ে সম্রাটের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন তাঁর পূর্ব পুরুষ আকবর, জাহাঙ্গীরের অনুসৃত নীতি হতে বিচ্যুত হতে। সম্রাট নিরুত্তর থেকেছিলেন। দারা নিজেও পছন্দ করেন নি সম্রাটের এই সিদ্ধান্ত। তবে মনের কথা মনে রেখেছেন। সিংহাসনে বসলে সবার আগে নতুন এক ঘন্টা লাগিয়ে দেবেন। আকবরী চার্চের সামনে শুকনো মুখে হাতির পিঠে বসে অপেক্ষা করছেন শাহজাদা দারা। প্রিয়তমা উদিপুরী রবিবারের বিশেষ প্রার্থনায় চার্চে এসেছেন। বিশেষ অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে দিতে এসেছেন দারা। উদিপুরী প্রার্থনার শুরুতে হাঁটু গেড়ে বসলেন কাঠের ঘন নকশাদার ‘পাপ-স্বীকারোক্তি’ ঘুপচি ঘরে। - হে প্রভু, আমি ভীষণ এক অপরাধবোধে ভুগছি। মিহি-মিষ্টি শব্দে পর্দার ওপাশে পাদ্রীর কান সজাগ হয়ে উঠলো। - আমরা সবাই প্রভুর দৃষ্টিতে অপরাধী। আড়াল হতে মৃদু স্বরে বলতে থাকলেন পাদ্রী। - আমার আর মহলে নাচতে ইচ্ছে করে না। খুক খুক করে কাশলেন পাদ্রী। বোঝালেন পরিচয় ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সতর্ক হলেন উদিপুরী। - আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না প্রভু। তবে নিজের জীবন অনেক ভালবাসি। আমার স্বামী আমি ছাড়া আরও ছিয়ানব্বই নারীর সঙ্গে বিছানা ভাগাভাগি করেন। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না। - সবই ঈশ্বরের ইচ্ছে কন্যা। তোমার বয়স খুবই কম। সারা জীবন পড়ে আছে সামনে। ধৈর্য্য ধারণ করাই পরমাত্মার ধর্ম। - আমি চাই যিনি আমাকে ভালবাসবেন তিনি শুধু আমার হবেন। এই চাওয়া কি অন্যায়? - নিশ্চয় ঈশ্বর তোমার ইচ্ছে পূরণ করবেন। - আলেলুইয়া। চোখ ছলছল করে উঠলো উদিপুরীর। - আলেলুইয়া ইশারায় শূন্যে ক্রুশ আঁকলেন আর্মেনিয়ান পাদ্রী। দারার নিজেরও ইচ্ছে ছিল চার্চের টানা কাঠের চেয়ারে বসে যীশুর মূর্তির দিকে তাকিয়ে ধ্যান করবেন। কিন্তু সম্রাটের বাল্যকালের দোস্ত মীর্জা জুল কারনাইন ইশারায় মানা করে দিয়েছেন। জুল কারনাইন মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত বাইজেন্টাইন খ্রীস্টান আমীর। সম্রাটের একান্ত শুভাকাক্সক্ষী। তাঁর বাবা ইস্কান্দার ছিলেন সম্রাট আকবরের সভাসদ। সিরিয়ার আলেপ্পো নগরী হতে আসেন আগ্রায়। বলা হয়ে থাকে আকবরের খ্রীস্টান বেগম আর্মেনিয়ান সুন্দরী মরিয়ম জামানী বেগমের খ্রীস্টান বিয়ের ঘটকালিতে জুল কারনাইনের বাবার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এই কাহিনী দারাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল জর্জিয়ান রূপসী উদীপুরিকে বিয়ে করতে। সেই সূত্রেই জুলকারনাইন দারাকে পরামর্শ দিয়েছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতে চার্চের কর্মকাণ্ড হতে আপাতত দূরে থাকতে। সুন্নী আমিরদের সমর্থন এমনিতেই দারার পক্ষে নেই। আওরঙ্গজেব ধর্মের ইস্যুটিকে খুব ভালভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। দারা একটা পাল্টা বুদ্ধি বের করেছেন। দিল্লীর সুফী পাগলা সারমাদকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন। সকল মুক্তমনা সুফী সাধকদের মাথায় ঢুকে গেছে, দারা যদি দিল্লীর বাদশাহ না হতে পারেন তবে সব মন্দির-চার্চ এমনকি শিয়াদের মসজিদ পর্যন্ত আওরঙ্গজেব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবেন। সারমাদ সব সময় উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করেন। পোশাকের বাহুল্য তাঁর অপছন্দ। সারা দিল্লী চষে চিৎকার করে তিনি বলে বেড়াচ্ছেন, ‘দারা ছাড়া তোমাদের কোন উপায় নেই, হিন্দুস্তানের সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র দারা শিকো’। এভাবে প্রকাশ্যে দারা’র পক্ষ অবলম্বন করার সংবাদে আওরঙ্গজেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সারমাদ’কে আওরঙ্গজেব বদ্ধ-উন্মাদ ছাড়া আর কিছু মনে করেন না। পবিত্র কলেমার পুরোপুরি সারমাদ কখনো নাকি উচ্চারণ করেন না! কত বড় আস্পর্ধা! ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু’ তারপর? মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন পাগলটাকে চরম শাস্তি দিতে হবে। অবশ্য তার আগে হটাতে হবে নাস্তিক দারাকে। (চলবে)
×