ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বিচিত্র দেশের গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৯ মে ২০১৭

বিচিত্র দেশের গল্প

আবিদ হাসান খানের ‘পেরু বিচিত্র দেশ’ বইটি প্রকাশ পায় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সাজেদুর রহমান। বইটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়েই গ্রন্থকারের একটি সচেতন প্রয়াস। একটি সুসংবদ্ধ কাহিনী সম্ভার যা শুরু করা হয় ভিসা পাওয়ার জটিলতা থেকে আরম্ভ করে টিকেট নিশ্চিত করা সর্বোপরি আকাশে উড়াল দেয়া। যাত্রাপথে যতদূর দেখা যায় আকাশের আলো আঁধারি প্রতিবেশের ভিন্ন রূপ দর্শন এবং শেষ অবধি লিমা বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছানোর এক চমৎকার ভ্রমণ বিবরণ পাঠককে মুগ্ধ করে। পাঠকের গ্রন্থকারের বর্ণনায় পেরুর একটি স্পষ্ট চিত্র সামনে চলে আসে। দক্ষিণ আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ পেরু। আয়তন ১৩ লাখ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ পেরুর আন্দিজ পর্বতমালা দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক ভিন্নমাত্রার আয়োজন। প্রাচীন সভ্যতার ধারক পেরুর আদিতম নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় খ্রিঃ পূঃ ১০ হাজার বছর আগে। পেরুর ইনকা সাম্রাজ্য আদি সভ্যতার নিদর্শন। কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের আগ থেকেই ইনকা সবচেয়ে বড় রাজ্য ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা এই দেশ দখল করলে লিমাকে রাজধানী শহরের মর্যাদা দেয়া হয়। জনসংখ্যা প্রায়ই ৩ কোটি ১২ লাখ। ২৫% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করলেও ২০১১ সালে দেশটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত (৭৮%) দেশটিতে ২০% ইউরোপীয় বাকিরা আফ্রেএশিয়ান। মূল ভাষা স্প্যানিশ। খনিজ সম্পদ, কৃষি, মৎস্য ও শিল্প উৎপাদন পেরুর সামগ্রিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। নতুন সপ্তাশ্চর্য ‘মাচু-পিচ্চুর’ আবিষ্কার পেরুর পর্যটন শিল্পও পুরো অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ১৪টি অধ্যায়ের সুষ্ঠু সমন্বয়ে লেখক পেরু ভ্রমণের ঘটনা পরম্পরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তুলে ধরেছেন, যা শুধু দেশটিকেই চেনাবে না লেখকের সুচিন্তিত অভিব্যক্তিও পাঠকদের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাবে। ‘কুজকো শহর এবং ইনকা সংস্কৃতি’ অধ্যায়টি আকর্ষণীয় এবং পেরুর ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নিদর্শন নিয়ে গ্রন্থের রূপকারের এক অনবদ্য নির্মাণশৈলী। যেখানে কুজকো শহর থেকে আরম্ভ করে ইনকা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়ানো ‘মাচু-পিচ্চুর’ সৌন্দর্য সৌধ স্থান পায় যা দেশটিকে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে আলাদা করে দেয়। সঙ্গত কারণে পর্যটন শিল্পেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। ‘মাচু-পিচ্চুর’ অভিযান অধ্যায়েÑ এই ঐতিহ্যিক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের অপরূপ বর্ণনা পাঠককে নিয়ে যায় এক স্বপ্নময় রাজ্যে। সত্যিই সে এক সবুজ বন এবং তুষরাচ্ছন্ন আন্দিজ পর্বতমালার মিলন-সৌধে গড়া অপূর্ব নৈসর্গিক বৈভবের রূপময় নগরী। যেখানে অভিজাত শ্রেণী, ধর্মযাজক কিংবা পুরোহিতদের মতো সমাজের প্রথম সারির নাগরিকরাই বসবাসের জন্য বিবেচিত হতো। এই পবিত্র নগরী নিরাপত্তার কারণে এতটাই সুরক্ষিত ছিল যে এখানে প্রবেশ করার পথটিও ছিল বেশ দুর্গম। সহজ পথে এখানে গমন করাটা ছিল প্রায়ই অসম্ভব। ফলে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এই অভিজাত এলাকাটিতে বিজয়ী স্প্যানিশরাও অভিযান চালায়নি। তবে ইতিহাস যা বলে স্প্যানিশরা পেরু দখল করার পরই ‘মাচু-পিচ্চুর’ অধিবাসীরা শহরটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা দিয়ে বন-জঙ্গলে নতুন করে নিজেদের জায়গা করে নেয়। এখানকার আদি অধিবাসীরা এতই বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান ছিলেন যে তারা শহরটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার কোন সূত্রই চিহ্ন হিসেবে রেখে যায়নি। ফলে স্প্যানিশ শাসনের চার শতক বছরেও এর যথার্থ অবস্থান বের করা সম্ভব হয়নি। পেরুর প্রতিটি দর্শনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত পরিশীলিত এবং নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে লেখক নিজস্ব রচনাশৈলীর অনবদ্য স্বাক্ষর রাখেন। নদী-বিধৌত আমাজান থেকে শুরু করে প্রতিটি শহর কিংবা স্থাপনার নিকটবর্তী বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেলে অবস্থান, হেঁটে সবুজ ঘন জঙ্গল ঘুরে বেড়ানোর অভিনব বর্ণনা লেখকের সৃজন ক্ষমতার অদ্ভুত সংযোজন। বইটি পাঠক সমাজে আদৃত হবে এবং পেরুর মতো একটি সমৃদ্ধ নগরীর বহুমাত্রিক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। গ্রন্থটির সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি।
×