ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ গোরখোদক

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৯ মে ২০১৭

গল্প ॥ গোরখোদক

শনিবার। ইয়াসিন মিয়া খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে দেখে চটটটে ঘামে ভিজে গেছে বালিশ। রাতের রাখা পান্তা থেকে টক টক গন্ধ আসছে। দড়িতে ঝোলানো গামছাটা টানতে গিয়ে নরম হয়া আসা দড়িটা প্রায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কোন রকমে আটকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ইয়াসিন। চারপাশে ঝোপ জঙ্গল। পরিষ্কার করতে মন চায় না। মাটির খোরাক মাটির গাছ কেটে নিলে মাটি খাবে কি! পেশায় ইয়াসিন আলী গোরখোদক। গোর খননের কাজ সে করে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। বাঁ চোখের অর্ধেকটায় ছানি। শরীরটা কিন্তু বেজায় মজবুত। গরমে রোদে খোলা কালো শরীরে যত পেশী আছে যেন হীরার মতন চকচক করে উঠছে। - ইয়াসিন মিয়া আছো নাকি? দূর থেকে ডাক শুনে সতর্ক হয় ইয়াসিন মিয়া। গ্রামের এক প্রান্তে থাকে সে। তার খোঁজে আসা মানে ভাল কিছু তো না। খারাপ খবর। দুনিয়ার সবখানে কত ভাল ভাল কিছু হয় ইয়াসিন মিয়ার কপালে জোটে মরার খবর। কোথায় কে মরল আবার! ‘ইচ্ছা করতেছে মাটি কামড়ায়া পইড়া থাকি’ একা একাই নিজের মনে বিড় বিড় করতে থাকে ইয়াসিন। মাটি ও মাটি মাটিরে পাও কেন চুলকায়? কই লইয়া যাইবি? কুন বিদ্যাশে তুর সাধ। ‘মাটি গড়ায়, মাটি কান্দে, মাটি বুক খুইলা দেয়’ কত রকম কা-ই না দেখছে এই জীবনে ইয়াসিন মিয়া। প্রতিবার গোর খোঁড়ার আগে ইয়াসিন মিয়ার বুক ধুঁক ধুঁক করে। ‘মাটি টের পায় কারে শুয়াইব ওরা। কি শক্ত মাটি, কি নরম মাটি, কি গলগল কইরা জল উইঠা ভরায়া ফেলে বুকের ভেতর। মাটি মাগো ও মাটি গো আমার কুথায় নিয়া যাবা আমারে চলো।’ পান্তাটুকু খেয়ে রওনা হয় ইয়াসিন মিয়া। দরজা বন্ধ করার কিছু নেই। গ্রামে ইজ্জত আছে তার। চোরে নিয়া গেলে তার কবরটা খনন করবে কে! মনে মনে হাসে ইয়াসিন মিয়া। মায়ের গোর খোঁড়ার মধ্য দিয়ে তার এই জীবনের শুরু। কি শক্ত মাটিই না ছিল সেটা। বাপে মরেছিল মেলা আগে। ইয়াসিন মিয়ারে বড় করতে মায়ের অনেক কষ্ট হয়েছে। পরের বাড়ির কাম করে মাটির সানকি ভরে ভাত নিয়ে আসত মায়। দুজনের কি তাতে হয়? ইয়াসিন মিয়ার একাই সব খেয়ে ফেলতে মন চাইত। এত খাদ্য কোথায়? গলার ভেতর কত কান্না গিলে গিলে খেয়েছে ইয়াসিন। কতদিন মায়ের কাছে কিছু আবদার করেনি সে শুধু ভাত ছাড়া। তার পর সময় বদলাতে দেখেছে চোখের সামনেই। এক সময় নতুন নতুন মানুষ আসত মায়ের কাছে। ইয়াসিন বাইরে বসে খেজুর বিচি দিয়ে বাঘডাসা খেলত। আপন মনে কাটত ষোলো ঘুঁটির ঘর। একটু বড় হলে ইয়াসিন বাড়ি ছেড়ে গঞ্জে পালিয়ে যায়। মন কে কত গল্প শুনিয়েছে যে। কত অন্ধজনের দিনরাত্রি যাপন করেছে তার মন একেকটা দিন। আড়তদারের দোকানে মাল তোলার কাজ নিয়েছিল। তারও কিছু দিন পর খবর পায় মা মরেছে। ‘কে মাটি দিব? কে গোর কাটব!’ কেউ না। কেউ না। ইয়াসিন মিয়া সারাদিন বসে ছিল মায়ের লাশের কাছে। মায়ের অপরূপ দেহটা কালো বর্ণ ধারণ করেছিল সেদিন। ধোঁয়ার মতো শরীর থেকে রূপ কোথায় যে যায়! বর্ষার আকাশের মতো ঢেকে যায় মেঘে, ধূসর মেঘ, কালো কালো মেঘ, দৈত্য দানোর মতো ভাসা ভাসা মেঘ চোখের সামনে সব অন্ধকার করে দিয়েছিল। শরীর যেন তখন শরীর না। মাথার ভেতর কোন বোধ ছিল না ইয়াসিন মিয়ার। পচা-গন্ধ বের হতে শুরু করলে এক সময় নিজেই কোদাল তুলে ঘরের পশ্চিম দিকে জাম গাছের নিচে মাটি খোঁড়া শুরু করে। কি শক্ত। কি শক্ত সেই মাটি। ইয়াসিন মিয়ার হাত ফসকাতে থাকে, ফোসা পড়ে যায়, ফোসা গলে যায়। ইয়াসিন মিয়া হাল ছাড়েনি। মায়ে যেন আরও পচতে থাকে। ঝিঁঝিঁ ডাকে জোনাক ওড়ে, বুনো ফুল থেকে সুবাস আসে, মাটির ভেতর থেকে কিছু একটা যেন ইয়াসিনের মনটা অবশ করতে থাকে। কিছুতেই থামে না সে। মায়ের বহুদিন কোন খোঁজ রাখেনি। কত অভিমান কত অপমান সে জমা রেখেছিল বুক পকেটে। সে সব হয়ত তাকে বাড়ির পথ ভুলিয়ে দিয়েছিল এতদিন! মনের ভেতরে হু হু করে ওঠে। মাটিরে প্রথম মা বলে ডাকে ইয়াসিন। চোখ থেকে ছিটকে কান্না আসে। যেন বা সেই কান্নার জলেই মাটি ভিজে, মাটি নরম হয়। তর তর করে কাটা হয়ে যায় গোর। শক্ত আর পচতে শুরু করা মায়ের শরীরটাকে ইয়াসিন আরেক মায়ের কোলে শুইয়ে সারারাত বসে থাকে পাশে। মরার গোর খোঁড়ার জন্য গোরের মাপ দরকার ইয়াসিনের। ইয়াসিন পথের ভেতর পা টেনে টেনে চলে। মাটিকে তার মনে হয় ছোট্ট নরম একটা অবুঝ শিশু। জুতার শক্ত পাটায় কষ্ট হয় যেন, জুতার দাগ বসে যায় শিশুর গালে। ইয়াসিন জুতা পরা ছেড়েছে সেই কবেই। খালি পায়ে মাটির ওপর দিয়া হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয় আরও কত শত লাখো মানুষই না তার পাশে পাশে হাঁটছে। এই মাটিই শেষ কথা, আবার এই মাটিই গর্ভে নিয়ে আরেক জীবনের জন্ম দিচ্ছে অন্য কোন মায়ে। বিপুল রহস্য নিয়ে যে শরীর জন্মায় মাটির ভেতরে, ঠা-া শীতল শরীরটাকেই আবার অন্য কেউ কাঁধে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে রেখে আসে। এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কত লাখ মৃত্যুই না হয় জীবনের। এক জীবনের মধ্যে অসংখ্য জীবন নিয়ে ইয়াসিন মিয়াও হাঁটে মৃত্যুর দিকে। ইয়াসিন মিয়াকে গোরখোদকের এই জীবনে কত রকম মানুষের জন্যই না মাটি খুঁড়তে হয়েছে। কবর খুঁড়তে গিয়ে ইয়াসিন দেখেছে মাটি যেন কোন কোন শরীরকে নিজের মধ্যে নিতেই চায় না। ইয়াসিন কত চেষ্টা করে পরিশ্রম করে অথচ মাটি কিছুতেই তৈরি হয় না। তলডাঙ্গার মাতবরের কবর তিন বার জায়গা বদল করে করে কেটেছিল সে। প্রতিটা পেশী শক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে, মাটির কাছে অনুনয় করে ইয়াসিন। হাল ছেড়ে দিতে মন চায়। কোথাও কি কেউ কঠিন নারাজ হয়ে আছে মাতবরের ওপর? অবিচারের বিচার কি মাটিই করছে এবার? ‘মাটি গো মাগো ও মা মাটি আমার তুমি ক্ষমা কইরা দাও তারে, শরীরে ফিরায়া নাও, গর্ভে ফিরায়া নাও মাগো’ কত অনুনয় না সে করে, চোখ ফেটে আসতে চায়, তিয়াসে বুকের ছাতি চড়চড় করে শব্দ করে, শরীরে বল পায় না ইয়াসিন, বিড় বিড় করতে থাকে এক মনে। মাতবরের বড় পুত্র খোঁজ করতে আসলে শুধু বলে ‘বাপধন সবার কাছে বাপের হইয়া নত হও, মাটি গোস্বা হইয়া রইসে বাপগো। ‘ নিজের স্ত্রীর কবরটাও নিজ হাতে খুঁড়েছিল ইয়াসিন। এত ভেজা মাটি, এত রস। জলের বানে যেন ভেসে যাবে শরীর। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে গাছের গায়ে।ইয়াসিন কত মরা হাড় গোড় সরিয়েও যেন সেই জলের কূল করতে পারেনা। কোথা থেকে এত জল জমিয়েছে মাটি তার শরীরটায়। পলিথিন বিছিয়ে বালু ফেলে তার উপর স্ত্রীরে শুইয়ে দেয় সে। ‘মাটিরে কি জলের কষ্ট দিসিলা বউ কুনুদিন?’ নিজের মনে বিড় বিড় করে ইয়াসিন। কত পথ পার হতে হয় ইয়াসিনকে। কত শনিবার পার হয়, কত মঙ্গল বার। ইয়াসিন মাটির গল্প মাটির কাছে করতে পারে, মানুষের কাছে করতে পারে না। সে কি পাগল? কেন তার এসব মনে হয়? ভাতের নলা মুখে দিয়ে সে টের পায় শস্যের জীবন। মাটি কত মমতায় না এসব শস্যকে ধরেছিল পেটের ভেতর। মাথার মধ্যে কত কথা যে আসে, ইয়াসিন মিয়ার কান্না পায়। শুধু কান্না পায়। নিজের ক্ষুদ্র একটা জীবন নিয়ে সে আরেকটা গোর খোঁড়ে। তারপর আরও একটা। তারও পরে সে আরও একটা গোর খোঁড়ে। দূর দূর গ্রাম থেকে ইয়াসিন মিয়াকে নিয়ে যায় লোকে। খবর দিয়ে নিয়া যায় আরও একবার। পানিতে ডুবে মরেছে একটা ছয় বছরের শিশু কন্যা। নিজের কোন দিন সন্তান হয়নি তার। তবু ইয়াসিন মিয়া যেন বুকের ওপর পাহাড় নিয়ে এগিয়ে যায়। মায়ের আর্তি কানে নিয়ে, বাপের বুক ফাটা আর্তনাদ কানে নিয়ে মাটির কাছে যায়। মাটির গায়ে হাত রাখে। মাটি যেন তৈরি হয়েই ছিল। বাগান যেমন ফুলকে বুকে নিতে কার্পণ্য করে না, নিজেকে মাটি এভাবেই প্রস্তুত করে রেখেছিল। যেন হা করেই ছিল, গাপ করে গিলে ফেলবে বলে আরেকটা জীবন। ইয়াসিন বিড় বিড় করে বলে ‘রাক্ষুসি হইছিস বড়। ক্ষুধা মেটাইতে আর কত খাদ্য লাগবে তোর? আর কত?’
×