ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

নিওপ্লেটনিক প্রেমের প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৯ মে ২০১৭

নিওপ্লেটনিক প্রেমের প্রকাশ

পরম সুন্দরের টান মানুষের মনকে প্রতিনিয়ত টানছে বিচিত্র ছন্দে বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে। তাই মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি তার শিল্প দিয়ে এমন বিচিত্র রূপ ধরে আসছে যেন চিরযৌবনের দেশে নতুন নতুন ফুল ফুটেই চলেছে। একটি ছবি এমনিতেই অনেক কথা বলে। কিন্তু শিল্পীরা চান তাদের ছবি আরও কিছু বলুক। বিশেষ করে যে শিল্পীরা বিশ্বাস করেন রহস্য মানেই সুন্দর, তাদের ছবিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে অনেক না বলা কথা। তেমনই একটি ছবি হলো আদি রেনেসাঁ যুগের অন্যতম শিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লীর ‘প্রিমাভেরা’। সময়টা ছিল রেনেসাঁর। মানুষের মনে তখন নবজাগরণের ছোঁয়া। নবজাগরণের সেই যুগে বত্তিচেল্লীর অনন্য সৃষ্টি ‘প্রিমাভেরা’ দেখার সুযোগ মেলে সবার। আনুমানিক ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয় এই বিখ্যাত ফ্রেস্কো বা দেয়ালে আঁকা পেইন্টিংটির। এই কাজে বসন্ত এসেছে রূপক হয়ে। ইউরোপে আজও এই ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বিতর্কিত ছবি। ‘প্রিমাভেরা’ নিয়ে আজ অবধি সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়েছে। সজীব এক বানন্তে চমৎকার এক উদ্যানে উপকথার চরিত্ররা সমবেত হয়েছে। আপাতদৃষ্টে একদল নারীর সৌন্দর্য আর উল্লাসের উদযাপন ধরা পড়লেও এ ছবিটি উদ্যানতত্ত্ববিদদের কাছেও আকর্ষণীয়। কারণ ধারণা করা হয় এ ছবিটিতে রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফুলের নমুনা। বিশেষজ্ঞরা এসব ফুলের মধ্য থেকে শনাক্ত করেছেন ১৩০ প্রজাতির ফুল। অজস্র ফুলের সমারোহ বলেই বোধহয় এর নাম হয়ে উঠেছে বসন্তের রূপক। কাস্তেল্লোর মেডিসি ভিলার এই শিল্পকর্মে ফুলেল বসন্তের এক চমৎকার উপস্থাপন দেখা যায়। বসন্ত মানে যদি ফুল আর প্রকৃতি হয় তাহলে এই ছবিটিই বোধ হয় বসন্তের সর্বোচ্চ শৈল্পিক প্রকাশ। ভাল করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এই অসামান্য শিল্পকর্মে রয়েছে ফুলের বর্ণিল সমারোহ। এ ছবির পরতে পরতে মেলে বসন্তের আবহ, যদিও বসন্তকে সামনে রেখে ছবিটি আঁকা হয়নি। গেভানির মেডিসি পরিবারের কারোর বিয়ের উপহার হিসেবে এই শিল্পকর্মের সৃষ্টি। কারণ এই ছবিতে মেডিসি পরিবারের দুজন মডেল হিসেবে এসেছেন বলে ধারণা করা হয়। বসন্তকে মাথায় রেখে কিংবা নিছক বিয়ের উপহারের উদ্দেশ্যে, যে কারণেই হোক না কেন বত্তিচেল্লী এই এক ছবির মাঝেই ঘটিয়েছেন নানা কিছুর সমারোহ। রোমান পৌরাণিক কাহিনীর একাধিক চরিত্র, মেডিসিদের উপস্থাপন, প্লেটোর আদর্শের ইঙ্গিত, বসন্তের স্ততি প্রভৃতি ছবিটিতে প্রতীয়মান হয়। দেয়ালজুড়ে এই চিত্রকর্মে আছে বেশ কয়েকজন পৌরাণিক দেব-দেবী, আর এদের মাঝেই কোলের আঁচড় থেকে বসন্তের আগমনী দূত ফুল ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশাল আকৃতির ‘প্রিমাভেয়ার’ বিশেষত্ব হল যে, এটি দেব-দেবীদের প্রথম প্রায় নগ্ন পূর্ণাঙ্গ ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর কয়েকটি ফিগার প্রাচীন ভাস্কর্য রীতিতে তৈরি, যদিও বত্তিচেল্লীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান। প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের এই ছবির মূলকেন্দ্রে রয়েছে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস। ভেনাসের আগমনে পৃথিবীতে লেগেছে রঙের ছোঁয়া। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে পৃথিবী। ছবির মাঝখানে লাল কাপড়ের আবরণে ভেনাসের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ভেনাসকে বসনাবৃত করার কারণ হয়ত এটা বোঝানো যে পৃথিবীতে বসন্ত এসেছে। সচরাচর পৃথিবী নগ্ন থাকে কিন্তু বসন্তে এই পৃথিবীই সেজে ওঠে বর্ণিল সাজে। নগ্ন ভেনাসও তেমনভাবে সেজে উঠেছেন এখানে। নয়টি ফিগার আছে ছবিটিতে তাদের প্রায় সকলের পা আলতো করে ছুঁয়ে আছে মাটি। সবাই যেন নিজ নিজ ভাবনায় নিমগ্ন। চিত্রে পুরুষের তুলনায় নারীকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন শিল্পী। যা তাঁর চিত্রকর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে মাথা ঘামাননি শিল্পী। সারি সারি সাজিয়েছেন ফিগারগুলোকে একফালি ডিম্বাকৃতি সবুজ জমির উপর। পেছনের দৃশ্যটি এমন, যেন ফুলের কার্পেট। এরই মধ্যে একেবারে আলাদা, বিচ্ছিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস। তার মাথা সামান্য হেলানো। মাথার ওপরে নারাঙ্গী বনের একটি ডাল খিলানের মতো করে নোয়ানো। ডান হাত বিশেষ মুদ্রায় উপবিষ্ট এবং বাম হাতে পরনের কাপড় ধরে আছে। ছেলে কিউপিড চোখবাঁধা অবস্থায় ভেনাসের সঙ্গী। সে উড়ন্ত অবস্থায় ‘থ্রি গ্রেস’ কে লক্ষ্য করে আগুনের বান ছুড়তে উদ্যত। ভেনাসের ঠিক মাথার উপরে চিত্রের মাঝ বরাবর তার অবস্থান। বাতাসের দেবতা জেফিরাসকে দেখা যায় ছবির ডানপাশে। সে ছবির অন্য সবার থেকে আলাদা। কিছুটা মেটে ও নীলচে রঙের। তার নিকটতম সহচর ফিলফিনে সাদা একটি নারী যার অভিব্যক্তি এবং অপ্রাকৃত রূপ তাকে বাকি সবার থেকে পৃথক করেছে। জেফিয়াস এই বসন্তের দুনিয়ায় ক্লোরিসেমের আগমনকে হাসতে হাসতে ঠেকিয়ে দিতে চায়। ফুলেল পোশাকে আচ্ছাদিত ফ্লোরাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় দেখায়। পৃথিবীর প্রাঙ্গণে ফুল ছড়িয়ে যাচ্ছে সে। মুখে সামান্য হাসি পরিলক্ষিত হয়। ছবির বামে রয়েছে শিরোস্থান পরিহিত মার্কারী, যে লাঠি হাতে নিয়ে শীতের ধূসর মেঘকে সরিয়ে স্বর্গোদ্যানকে রক্ষা করছে এবং বসন্তের মেঘকে জায়গা করে দিচ্ছে। মার্কারির দেহেও লাল রঙের বস্ত্র। ছবিতে আরও রয়েছে সজীবতার প্রতীক তিন অভিজাত নারীর দল। যারা পরস্পর বিশেষ মুদ্রায় এক হাত উপরে রেখে নৃত্যরত। দুই নারীর গলায় বিশেষ ধরনের নেকলেস পরিহিত দেখা যায়। তাদের তিনজনের গহনার নকশা, ভঙ্গিমা আর চুলের ধরন সবই একেবারে ভিন্ন। ধারণা করা হয় এদের সব গহনা মেডিসিদের বাড়ির গহনার অনুকরণে আঁকা। যদিও গহনাসহ এই তিন নারী স্বর্গের আবহকে প্রকাশ করছে। এদের গায়ের স্বচ্ছ লম্বা পোশাকগুলো বত্তিচেল্লীর অনবদ্য সৃষ্টি। ছবির অধিকাংশ ফিগারগুলো দীর্ঘ সুকুমার, বিশেষত নারী ফিগারদের একটু উঁচু তলপেট যা সেকালে নারী দেহের সৌন্দর্যের অংশ বলে বিবেচিত হতো। ফিগারে বাইরের রেখা অঙ্কনের মাধ্যমে অনুভূতিকে যথার্থভাবে প্রকাশ করেছেন শিল্পী। ইন্দ্রিয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে মানসিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যা চিন্তা-ভাবনা ও বিশেষ অনুভূতির উদ্রেক করে। ‘প্রিমাভেরা’ চিত্রে মুখে ও অবয়বে কোমল স্পর্শ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বিশুদ্ধ, বিমল ও সকলের দৃষ্টি পবিত্র। মনে হয় জীবন্ত। মনে হয় যেন অভিনয় করছে। ছবিতে বাস্তবতা এমনভাবে ফুটে উঠেছে যে, লোকে দেখলেই বুঝতে পারবে এটি বত্তিচেল্লীর কাজ। অলঙ্করণের ডিটেইল এর কাজ ভারি সূক্ষ্ম। মহত্তম দর্শন ব্যতীত উচ্চতর শিল্প সম্ভব নয়। বত্তিচেল্লীর এ চিত্রে নিওপ্লেটনিক দর্শনের প্রভাব লক্ষণীয়। সুন্দরকে প্রত্যক্ষ করতে পারলে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা হয়, ভেনাসের অসাধারণ শান্ত-চিত্ততা যেন তাই বলে দেয়। ছবিটি আপাত দৃষ্টিতে সেক্যুলার মনে হলেও ধর্মীয় চিত্রের মতোই জৌলুস এবং তাৎপর্যপূর্ণ। আবার কাজের পরিধি এবং কম্পোজিশনের ডিটেল খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় ভেনাসের মুখ তাঁর অন্যান্য ম্যাডোনার মুখচ্ছবির চাইতে আলাদা নয়। এখানে কেবল একটি আলোক বৃত্ত তার চারপাশে, ডান হাতখানি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে উত্তোলিত। ফিগারগুলোর হাতের ওঠা-নামা বা আন্দোলনকে ভেনাসের হাতের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেই এঁকেছেন। একটি নকশি করা দৃশ্যপটের বিপরীতে এদের স্বচ্ছন্দ গতি ভঙ্গির মধ্যে বত্তিচেল্লী একটি ছন্দময় সংহতি তৈরি করেছেন। ঝোপঝাড়ে ঢাকা-আলো আঁধারি আবহে চিত্রিত উজ্জ্বল সব চরিত্রগুলো যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। এতগুলো পৌরাণিক চরিত্র নিয়ে এত বড় কাজ সে সময় কেউ করেননি। ধর্মের প্রচ্ছায়া মুক্ত এই কাজ বত্তিচেল্লীর সবচেয়ে আলোচিত কাজ। রঙের আর ফুলের সমাহার নিয়ে এক অসাধারণ ভাবনার প্রতীক ‘প্রিমাভেরা’। নবজাগরণ আর বসন্তের আগমন নিয়ে অসামান্য এক দৃষ্টান্ত এই চিত্রকর্ম। একজন প্রতিভাবান মানুষ হিসেবে শিল্পী বত্তিচেল্লী স্বর্ণকারের চোখ দিয়ে প্রকৃতি দেখে ‘প্রিমাভেরা’ আঁকায় মনোযোগ দিয়েছিলেন।
×