ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলের গহনা

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৯ মে ২০১৭

জলের গহনা

স্মরণাতীতকাল থেকেই মানুষ যে কবিতাপ্রেমী সেটা পাঠক মাত্রেই কম-বেশি অবগত। যুগে যুগে, কালে কালে আবেগপ্রবণ মানুষ তার হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেছে ছন্দে ও কবিতায়। সচেতন পাঠকমাত্রেই জানেন যে বাংলা সাহিত্যের আদিরূপ কবিতা। মহামহিম হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্ধারকৃত চর্যাপদকেই গবেষকরা বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শনরূপে স্বীকৃতি দিয়েছেন যা রচিত হয়েছিল কবিতার আকারে। একইভাবে আমরা দেখি ইংরেজী সাহিত্যের ও প্রাচীনরূপ এবং প্রথম দির্শন কবিতা। ‘ঝবধভধৎবৎ’ ‘ডধহফবৎবৎ’, ‘উৎবধস ড়ভ ঃযব জড়ড়ফ’ ‘উবড়ৎ’ং খধসবহঃ’, ‘ডরফংরঃয’ ইত্যাদি কবিতাগুলোকে ইংরেজী সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে। যদিও এগুলোর রচয়িতা কে বা কারা সে বিষয়ে অকাট্য প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে এগুলো রচিত বলে মনে করা হয়। সমসাময়িককালের একটি বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ‘ইবড়ঁিষভ’ মহাকাব্যটির কাব্যিকতা বিশ্বব্যাপী পাঠককে আজও মুগ্ধ করে। গবেষকরা এগুলো রচনার কৃতিত্ব আরোপ করেন ঈুহবঁিষভ নামক একজন কবির ওপর। কেউ কেউ আবার এগুলোকে ঠবহবৎধনষব ইবফব-র রচনা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আবার দু-একজন সমালোচক মনে করেন এগুলো ঈধবফসড়হ নামক কবির কীর্তি। সে যা-ই হোক কবিতা যে ইংরেজী সাহিত্যেরও প্রথম নিদর্শন এতে কোন সন্দেহ নেই। অন্যান্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও হয়ত একই তথ্য মিলবে। এটা সহজেই অনুমিত যে, সাহিত্য কী সেটাও মানুষের যখন বোধগম্য ছিল না। তখনও মানুষ কবিতা রচনা করেছে আবেগে। রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ যথার্থই কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেÑ ‘কবিতা হচ্ছে মানুষের শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত (উপচেপড়া) বহির্প্রকাশ’ ‘(চড়বঃৎু রং ঃযব ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ঋববষরহমং)’ মানুষের আর্থিক অভাব-অনটন, বিদ্যাশিক্ষার অভাব কিংবা কর্ম ব্যস্ততার কারণে সময়ের সঙ্কট কোন কিছুই কাব্যিকতাকে চেপে রাখতে পারেনি। কবি ওয়াডর্স ওয়ার্থের এ সংজ্ঞার পরিপূর্ণ সত্যতা মেলে কবি সাইফুল্লাহ আল মামুনের কাব্যগ্রন্থ ‘জলের গহনা’তে। বাংলাদেশ পুলিশের একজন উঁচু স্তরের কর্মকর্তা হওয়ার কারণে তাকে অনিবার্যভাবেই সর্বক্ষণিক ব্যস্ত ও সজাগ থাকতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। ফলে অনেক সময় তার পারিবারিক জীবনও থাকে যথেষ্ট উপেক্ষিত। অথচ সাইফুল্লাহ আল মামুনের কাব্যিকতা থেমে থাকেনি। তাঁর জীবন ঘনিষ্ঠ শক্তিশালী অনুভূতিগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রকাশিত হয়েছে কবিতার আকারে। এ রকম ছোট-বড় চব্বিশটি কবিতার অপূর্ব সঙ্কলন তার ‘জলের গহনা’ নামক কাব্যটি। ‘এই কবিতাগুলো জীবন ও প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ নানাবিধ উপকরণে নিমগ্ন এক সময় সচেতন কবির স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ। তিনি জীবনকে অনুভব করেছেন মায়াবী পেলব জ্যোৎস্নার কিরণস্নিগ্ধ পবিত্র বাতাবরণে। আধুনিক ও চিন্তাশীলতার এক দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানে থেকে প্রকৃতি, সমকাল ও দেশকালকে অনুভব ও লালন করেন নিজস্ব ঘরানায়।’ এ কাব্যের শিরোনাম কবিতায় বেলাভূমির নিকটস্থ অগভীর স্বচ্ছ জলে পতিত সূর্যালোকে সৃষ্ট চাকচিক্যকে কবি জলের গহনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিরোনাম কবিতায় কবি চমৎকার উপমা ও তুলনা ছাড়াও অনুপ্রাসের সমাবেশ ঘটিয়েছেন যেমনÑ ‘পদ্মাপারের পদ্মমুখী’, ‘ডাগর ডাগর আঁখি’, ‘হাতছানির হাতখানি’, ‘তীরে ভিরাই তরী’ ইত্যাদি। ‘জলের গহনা’ কবিতাটি পরে কারও উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থের লুচি কবিতাগুলোর অন্যতম ‘ঝযব উবিষঃ অসড়হম ঃযব টহঃৎড়ফফবহ ডধুং’ কবিতাটি অথবা অবচেতনভাবে কারও মনে পড়তে পারে রবি ঠাকুরের’ সোনার তরী কাব্যের’ শিরোনাম কবিতার কিছু অংশ যখন পড়বেনÑ‘ওগো মেয়ে কোথায় নেমে তোমার ঢেউয়ে। তীর ভেঙ্গেছে ঘর ভেঙ্গেছে আর কী হবে।’ কবি সাইফুল্লাহ আল মামুনের কবিতাগুলো নিজস্ব তার মূর্ত প্রতীক। কাব্যভাষা নির্মাণের চেয়ে কাব্যভাবনাকেই জোর দিয়েছেন। সমকালকে দেখেছেন কবি প্রকৌশলী ও প্রশাসকের চোখ দিয়ে। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞতার এক চলন্তিকা। অনুসন্ধিৎসু পাঠকমাত্রেই এতে খুঁজে পাবেন বৈচিত্র্য, ভাব প্রকাশ, ছন্দ প্রকরণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বহুমাত্রিকতা। সব ক্ষেত্রেই কবি নিজস্ব ধারা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। এই কাব্যে পাঠক খুঁজে পাবেন রোমাঞ্চ ও প্রকৃতিপ্রেম ‘জলের গহনা’, ‘তৃষ্ণা বলেই ডাকব তোমাকে’ কণ্ঠবিজরী, ‘কেউ ছিলে না’ ‘আলোর ঘর’ ইত্যাদি কবিতাগুলোতে। কবির প্রগাঢ় দেশপ্রেমের সুস্পষ্ট বহির্প্রকাশ ঘটেছে ‘রুপালি হাসি’, ‘মৃত্যুবীজ’, ‘শহীদ জননী’, ‘নদীর বুক’, ‘নগর নয়না, মেঘ নয়না হও, বৃষ্টি আমার ভালই লাগে’ ইত্যাদি কবিতাগুলোতে। যেমনÑ গাছ মাছ ধান বাংলার প্রাণ সবুজ চিত্তে নির্মল নৃত্যে আমারে করে চিরঋণে দান। (কবিতা-রুপালি হাসি) মুক্তিযুদ্ধে সন্তানহারা এক প্রতীকী মাকে খুঁজে পাওয়া যায় ‘শহীদ জনীন’ কবিতায়। ‘মনের মৃত্যু’, ‘ধর্মান্ধের অন্ধ চোখ’, ‘প্রার্থ নার অঙ্গীকার’, ‘মানুষ হলে’ প্রভৃতি কবিতায় কবির নিগূঢ় মানবপ্রেমের স্বাক্ষর খুঁজে পাবেন পাঠক। ‘খোদা মনে মনে ওই অভয় সদা লই অমানুষের সঙ্গে অমানুষী আচরণ করে, আমি যেন অমানষে রূপান্তরিত না হই।’ (মনের মৃত্যু) ‘কোটি কোটি ক্ষুধার্তে ও সম্মুখে দাঁড়িয়ে, আমি বিধাতার বিরুদ্ধে মিছিল করি যেখানে দু-মুঠো ভাত পরকালের স্বর্গে ও চেয়েও শ্রেয় সেখানে আমি বিধাতার প্রার্থ না করি না, মানুষের প্রার্থনা করি।’ এভাবেই কবি তার মানবপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকাশ করেছেন। কবি ধর্মকে ভালবাসলেও ধর্মান্ধতাকে যে অপছন্দ করেন তা প্রকাশ পেয়েছে তার ধর্মান্ধের অন্ধচোখ কবিতায়। কবি সাইফুল্লাহ আল মামুন দরিদ্রের প্রতি অতি সহানুভূতিশীল এবং ঈশ্বরভক্ত একজন মানুষ যার প্রমাণ মিলবে তার আত্মশুদ্ধির ব্যাকরণ কবিতায় যখন তিনি বলেনÑ ‘হত্যা করে সুখী হবে রক্তমাখা হাতে উপরওয়ালা বসে আছেন মাথার উপরে পালিয়ে যাবে, আড়াল হবে, কোন্ জগতে? আর যে কোন জগত নেই, তার জগতের বাইরে।’ পার্থ প্রতিম দাসের চমৎকার প্রচ্ছদে এবং কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থটির মূল্য ১০০ রুপী। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বাংলাদেশের অভিজাত লাইব্রেরিগুলোতে পাওয়া যাবে বইটি। এ কাব্যগ্রন্থটির জন্য কবি ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে সংবর্ধিত হয়েছেন। কবি সাইফুল্লাহ আল মামুনের পূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ (এলোমেলো পা-ুলিপি, জল জ্যোৎস্নার অষ্টমী এবং একশত কবিতাংশ) তিনটির চেয়ে জলের গহনা কাব্যের কবিতাগুলো অধিক পাঠকনন্দিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। মোঃ ছানোয়ারুল আলম
×