ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গন্ধরাজের ঘ্রাণ ॥ দেশপ্রেম, প্রকৃতি ও নস্টালজিয়ার নানা পাঠ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৯ মে ২০১৭

গন্ধরাজের ঘ্রাণ ॥ দেশপ্রেম, প্রকৃতি ও নস্টালজিয়ার নানা পাঠ

কবিতার বিশুদ্ধ কাব্যগুণ মাপা যায় না। তা জাদু। কাব্যের আঙ্গিকের মাপজোক হয়। সার্থক কবিতা কি প্রেরণার লটারির উপহার? নাকি তা সাধনা ও পরিশ্রমের ফল? কেউ কেউ যেন প্রথম থেকেই পরিণত স্টাইলের প্রভু। রাতারাতি তাঁদের খ্যাতিÑ যেমন সমর সেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আবার কেউ কেউ ধীরে ধীরে খোলস খুলে, শূক থেকে প্রজাপতিতে পরিণত হন যেমন সুধীন্দ্রনাথ। তবে এটা বাকদেবির অহেতুক কৃপা। এটা কি তাই যাকে একটু আগেই প্রেরণার লটারি বলে উপহাস করেছি? যেমন জমিতে হাল দেয়া না থাকলে বৃষ্টি এলেও লাভ নেই, কবি যদি মনের মাটি প্রস্তুত না রাখেন, কল্পনা তাঁকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলেও তা কবিতায় রূপ নেবে না। কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা উপলব্ধি করা মনে হয় বেশি কঠিন। কবির মনোভাব রসের পাখায় ভর করে সাহিত্যাকাশে উড়ে বেড়ায়। সেই রস পাঠককে আস্বাদন করতে হয়। পাঠকের বোধগম্য কবিতা কি সব কবি লিখতে পারছেন? কালোত্তীর্ণ কবিতা বা বহমান কাব্যসুর কি সবার কবিতায় ধরা পড়ে? কেননা, কাব্যসৃষ্টির জন্যও প্রয়োজন বিশেষ এক প্রতিভার। কবিরা সেই বিশেষ প্রতিভা নিয়েই জন্মান। সে জন্যই কবিতা গেঁথে যায় পাঠকের মনে। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’য় বলেছেন, ‘প্রত্যেক মনীষীরই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকেÑ নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধিও তাঁর নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভিতরে।’ সে কথার সূত্র ধরেই বলি, কবি কমরুদ্দিন আহমদের একটি বিশেষ প্রতিভা রয়েছে। সেই প্রতিভার গুণেই তিনি সিদ্ধ। তৈরি করেছেন নিজস্ব কাব্যজগৎ। প্রতিভা তাঁকে কবি বানিয়েছে। প্রকৃতি তাঁকে পূর্ণতা দান করেছে। কবিতার প্রতি একাগ্র বাসনা তাঁকে বানিয়েছে কবিঋষি। কবিতার সাধনায় তাঁর সিদ্ধি লাভ খ-কালীন নয় বরং দূরস্থায়ী। পাঠকের অন্তরে সর্ববিরাজমানতা তাঁকে সম্মানিত করেছে। জীবনানন্দের আলোচনায় ‘সৎ কবিতা’ এবং ‘খাঁটি কবি’ শব্দ দুটি পাওয়া যায়। কবিতারও সততা থাকতে হয়; কবিকেও হতে হয় খাঁটি। কবিতার সৎ-অসৎ বা খাঁটি-ভেজাল বলতে তিনি কবিতার চিরন্তন গ্রহণযোগ্যতাকেই হয়তো বুঝিয়েছেন। তাই এ সময়ে এসেও শব্দ দুটি চিরন্তন বাস্তবতার আলোকে প্রোজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই অর্থে- কমরুদ্দিন আহমদ একজন খাঁটি কবি। তাঁর কবিতা নিঃসন্দেহে সৎ। স্বল্প কথা, স্বল্প ভূমিকায় তাঁকে আলোকপাত করা যায় না। তাঁর পরেও বলতে হয়, তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ভূমিকারও প্রয়োজন হয় না। কবিতায়-ই চিনে নেয়া যায় কবিকে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় কবি-লেখকদের মধ্যে কমরুদ্দিন আহমদ অন্যতম। কমরুদ্দিন আহমদ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যখন যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সুনাম অর্জন করেছেন স্বমহিমায়। কী কবিতায়, কী প্রবন্ধে, কী গল্পে কিংবা ছড়ায়। এতসব গুণের অধিকারী যিনি তিনি ছড়াতেও সিদ্ধহস্ত হবেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর কাব্যচর্চার বয়সও অনেক। চলতি বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ প্রকাশ করেছে শব্দশিল্প প্রকাশন। যাপিত জীবনের হাসি-আনন্দ, স্মৃতি-নারীর প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতি প্রেম, দেশপ্রেম এমনকি স্বজনপ্রীতি প্রভৃতিই তাঁর কবিতার বিষয়গুলো খুবই সাধারণ, খুবই চমৎকার উপমায় ভরপুর। ‘গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রথমত কাব্যগ্রন্থটি নিখুঁত ছন্দোবদ্ধ রীতিতে রচিত। এতে ছড়া, কিশোরকবিতা এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কয়েকটি কবিতাও স্থান পেয়েছে; এমনকি কাব্যগ্রন্থটিতে সব বয়সের পাঠকের উপযোগী কবিতাও রয়েছে। যেমনÑ ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা ব্যক্ত করি মনের আশা দূর্বা-ঘাসের পাতায় শিশির শালিক ঝাঁকের কিচিরমিচির লালমুখো রুই খাচ্ছে দেখ আমার ভাষার খৈ কম্পুটারে নাচতে পারে ছোট্ট ডোবার কৈ।’ ... মায়ের ভাষায় কলম ধরি, ছন্দে রসে ভুবন গড়ি।’ এখানে কবি মায়ের মুখের ভাষা তথা বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছেন। এ ভাষা দিয়ে মনের আনন্দ-বেদনার সুর বাঁধা যায় সাবলীল ভাষায় শ্রুতিমধুর নানা শব্দে শব্দে। এটা গেল একটা দিক। আরো অন্তত দুটি বিষয়ে কবি কমরুদ্দিন আহমদ অনন্য। তাঁর মধ্যে দ্বিতীয়টি ‘গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ কাব্যগ্রন্থে ছন্দ ও সুরের আশ্রয়ে কবির প্রেম ও প্রকৃতি চেতনা অসাধারণভাবে শব্দের গাঁথুনিতে বাণীরূপ পেয়েছে। কবি গেয়েছেনÑ ‘শঙ্খনদী, শঙ্খনদী, কোথায় তোমার ঘর বুকের কাছে সবুজ ঘাসের মিনা করা চর। ... খর¯্রােতা জলের ছলে লক্ষ চাঁদের জোছনা গলে ও কিশোরী পাহাড়িকা বন্দী আমি তোমার ছলে।’ ‘গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ কী চমৎকার একটি নাম! কমরুদ্দিন আহমদের ‘গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ কাব্যগ্রন্থে মোট ৫৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থে অনেকবারই দেশপ্রেম-প্রকৃতিপ্রেম, নস্টালজিয়া এবং নদীপ্রসঙ্গ এসেছে। কেননা গ্রামের সবুজঘেরা অরণ্যে বা নৌকায় নদীতীরবর্তী জনপদে ঘুরে বেড়ানো কবির নেশা। কবি বলেন, ‘নদীর পাড়ে বনের ধারে এই তো আমার গ্রাম গ্রামই আমার অষ্টপ্রহর ভালোবাসার ধাম।’ (নদীর পাড়ে বনের ধারে) এই নদী তাঁর শৈশবের, যৌবনের, তারুণ্যেরও। নদীর মতোই সরলভাবে বহমান তাঁর জীবন। নদীর মতো স্বচ্ছ তাঁর পথচলা। কবির শৈশবস্মৃতি ও নদীরা অনেক কথা বলে। তিনি নদীর রচনাবলী পড়েন। আসমুদ্র ঢেউভাষা শেখেন। কবি বলেন, ‘গভীর রাতে দইজ্জ্যা হাঁকে প্রেম খুঁজেছি নদীর বাঁকে চরের ঘাসও অসংখ্য তীর মারলো আমার বুকে ফুল পাখিদের বিকাল ওভাই কাটে পরম সুখে।’ (প্রেম খুঁজেছি নদীর বাঁকে) এ কবিতায় তিনি দার্শনিক চিন্তার যে প্রক্ষেপণ করেছেন, তা হাজারো প্রশ্নের উদ্রেককারী, হাজারো প্রশ্নের বিশ্লেষণ এবং উপসংহারহীন তাঁর যাত্রা। আরেকটি ছড়া-কবিতা তুলে ধরা যাক, ‘কালো মেয়ের কালো খোঁপায় কনকচাঁপার ফুল কাঁচা সোনায় মিনা করে পরিয়ে দেবো দুল।’ (কালো মেয়ে) এই কবিতায় নারীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ফুটে উঠেছে চমৎকাররূপে-প্রকৃতির ছোঁয়ায়। তাঁর কবিতায় পরিবেশ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি চা এবং কফির তুলনামূলক পার্থক্য খুঁজেন। চায়ের দোকানে ধোঁয়া ধোঁয়া স্মৃতি খুঁজে ফেরেন। খুঁজেন হারানো মুখগুলো। তিনি কবিতায় একফোঁটা ভোরের শিশির উপহার দেন। বলেন,‘ কী সুন্দর এই বাঁশখালী পাহাড়-সাগর মিতালী মাঠে-বনে যতই দেখি সবুজ ফুরায় না- ভাইরে সবুজ ফুরায় না’ (কী সুন্দর এই বাঁশখালী)। জনজীবনের আমূল পরিবর্তন কবির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। নাগরিক যন্ত্রণা তাঁকে স্মৃতিকাতর করে তুলেছে। তিনি আক্ষেপ করেন। লেকের ব্যথিত জল দেখেন। দেখেন সুশী মেঘ। শহরের অ্যালবামে অনেক দিঘির ছবি ছিল একসময়। আজ নেই। শহরের ভবনের ছাদে কিংবা খোলা মাঠে লাটাই ছিলÑ সেসব আজ কোথায়? কবি শোনেনÑ ‘অসময়ে সেলফোন; রিংটোনে নকল কোকিল।’ সব নকলের মাঝে আমরা যেন আসলকেই হারিয়ে ফেলেছি। ভুলে যেতে বসেছি যা সত্য, যা কিছু চিরন্তন। ধ্বংস প্রতিনিয়ত সবুজের অরণ্যÑ যা আদৌ কাম্য নয়। গ্রন্থের ‘গোখরো সাপের বিষ’ তাঁর ক্ষুদ্র একটি কবিতা। এই একটি ক্ষুদ্র কবিতায় কত যে ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে, তা হয়তো বিদগ্ধ পাঠকই জানে। তাঁর কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনাও লক্ষ্য করা যায়। যারা মাতৃভূমিতে জন্ম নিয়ে দেশের সাথে বেঈমানি করে কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির কবলে পড়ে দেশের বা সাধারণের ক্ষতি করে তাদের বিরুদ্ধে কবির কলম সবসময় সোচ্চার। দুর্নীতিবাজ ভ- লোকের সঙ্গে কোনো আপোস করে না। তাই তো কবি বলেনÑ ‘শব্দকলায় লুকিয়ে রাখি গোখরো সাপের বিষ ভ- লোকের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।’ (গোখরো সাপের বিষ) তাঁর কবিতায় আসে ভাষা, দেশ, মা, প্রকৃতি, নদী, প্রেম, পাহাড়-ঝর্ণা এবং কবির জন্মস্থান বাঁশখালীর শৈশব-কৈশোরের নানা স্মৃতি। বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব মাহবুব আলম আন্ওয়ার’র স্মরণে কয়েকটি পঙ্ক্তি। স্মৃতিকাতর কবি মাহবুব আলম আন্ওয়ারকে উৎসর্গ করেন তাঁর ‘সেরা হাই-স্কুল’ কবিতাটি। স্মৃতি, উপমার আড়ালে জীবনের চরম সত্য এবং বাস্তবতা উচ্চারিত হয় তাঁর প্রতিটি কবিতায়। কবি অনেক কথা বলে যান অল্প কথায়। নিজের ক্ষুদ্রতাকে প্রমাণ করতে চান, অথচ এটাই যে তাঁর মহত্বের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কেননা কবি তো সব মানুষের পুঞ্জীভূত ছায়া। তিনি নবীন কবিদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগান। তাঁর বিশালত্ব কবিতায়। বিশালত্ব চিন্তায়-চেতনায়। তাঁর বিশালতা মেধা ও মননশীলতায়। তাঁর এই বিশালত্বের মাঝে এমন ক্ষুদ্র আলোচনা পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণে হয়তো যথেষ্ট নয়। তাই তার কাব্যের অমিয় সুধা পান করে তৃষ্ণা মেটানোর উদাত্ত আহ্বান জানাই। এমন একটি কাব্যগ্রন্থের জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা কবির প্রতি। কবি কমরুদ্দিন আহমদ একটি বৃক্ষের নাম; যার সুশীতল ছায়াতলে পাঠকের হৃদয় জুড়ায়।
×