ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্কাহীন জীবনের শুভসঙ্কেত কোথায়

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৯ মে ২০১৭

শঙ্কাহীন জীবনের শুভসঙ্কেত কোথায়

পরিবারের ছোট্ট পরিসর থেকে বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় নারীদের নিরাপত্তার বিষয় আজ নানামাত্রিকে আলোচিত হচ্ছে, পথনির্দেশ করা হচ্ছে, কোন মঙ্গলসূচকে নারীরা নিজেদের এই পর্বত প্রমাণ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসবে তার কিছু পরামর্শ বিভিন্ন বিজ্ঞজনের কাছ থেকেও আসছে। কিন্তু কোনটাই যে মূল সঙ্কটের গভীরে সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারছে না সেটাই সব থেকে বেশি আশঙ্কার বিষয় হয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও বিপন্ন করে তুলছে তা বলাই বাহুল্য। নারীরা নির্যাতনের শিকার, প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চনার শিকার, সম্পত্তির মালিকানা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, বাল্যবিয়ের নামে অপরিণত জীবনযুদ্ধের নির্মম বলি, যৌতুকের মতো ঘৃণ্য পণ প্রথার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া, অকাল বৈধব্যের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার রোষানলে পড়া, শারীরিকভাবে নিপীড়িত হয়ে সমাজ-সংস্কারের কাছে অপদস্থ হওয়া, নারী পাচারের মতো অসামাজিক অপকৌশলের কাছে জীবন বাজি রাখা সর্বোপরি অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সামাজিক ও অপসংস্কার থেকে আরম্ভ করে সমস্ত অন্যায়, অবিচার আর অভিশাপের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে এ সমস্ত অপতৎপরতা নীরবেÑ নিঃশব্দে বয়ে বেড়াতে হয় শুধুমাত্র নারীদেরই। এসব হীন্য সামাজিক বিধি কিংবা জোর করে চাপানো ব্যবস্থার কাছে পুরুষ সমাজের বিন্দুমাত্র দায়ভাগ থাকে না। তবে এ কথা সত্য শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নারী-পুরুষের চাইতেও অধিক গুরুত্ব পায় অর্থবিত্তের ফারাক। এর পরও বলা যায় সম্পদের বিভাজনের নিরিখেও নারীরা অনেকখানি পিছিয়ে থাকে। একজন ক্ষেতে খামারে কৃষক, দিনমজুর কিংবা কারখানার পুরুষ শ্রমিকের বঞ্চনা যতই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাক না কেন সেখানে একজন নারী সহকর্মীর অবস্থান যে কতটা নির্মম আর অমানবিকতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজুরি বৈষম্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানসিক এবং শারীরিক পীড়ন কোন সহযোদ্ধা নারী কর্মীকে একজন পুরুষের বিবেচনায় হরেক রকমের অবিচারের মুখোমুখি হতে হয়। যাদের সংখ্যাই সব থেকে বেশি। যারা শিক্ষার মতো সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ আবেদনকে গ্রহণ করতে না পারার কারণে এমন নিম্ন শ্রেণীর পেশায় নামতে হয়। শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে না পারলে ‘ব্যক্তিত্ব’ নামক অতি বাহুল্য শব্দটি এসব বঞ্চিত নারীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাটা কি ঠিক? এ অবস্থা তৈরির মূল শেকড় কোথায়? অতি বাল্যকালে শিশুকন্যাকে পাত্রস্থ করার মনোবৃত্তি নিয়ে মা-বাবা তার মেয়েকে তৈরি করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে বিয়েও দিয়ে দেন। ফলে শিক্ষা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অপরিহার্য সামাজিক চাহিদার অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আইন কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়ায় বাল্য বিবাহকে রোধ করা সম্ভবই নয়। দায়বদ্ধতা, নীতি-নৈতিকতা, মানবিক বোধ এবং কন্যাকে মানুষ হিসেবে ভেবে তার সমস্ত মৌলিক অধিকার অর্জনের সুযোগ দেয়া প্রতিটি স্নেহশীল পিতা-মাতার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় আনা সব থেকে জরুরী। শিক্ষা যদি কোন মেয়েকে সমস্ত অনাচার থেকে বের করে আনতে পারে তাহলে সে শিক্ষাকে কিভাবে শিশুকন্যাদের কাছে অবারিত করা যাবে তার একটা সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশনা নিতান্ত দরকার। এটা সত্য যে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মেয়েরা কিছুটা হলেও নিজেদের মান, সম্মান, অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে সামনে চলার সঙ্কল্প তৈরি করতে পারে। এই ব্যবস্থায় এক সময় যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথটাও ঠিক করে নিতে পারে তা হলেও নিজের সামাজিক অবস্থান অনেকটা জোরালো হয়। তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় সমাজের অন্যান্য মানুষের চিরায়ত মূল্যবোধের মানসিক মনোবৃত্তি। সেটা যদি সুস্থ এবং স্বাভাবিক থাকে তাহলে চলার পথও নির্বিঘœ, নিষ্কণ্টক হয় বিশেষ করে মেয়েদের এগিয়ে চলার পথ। আর তাই মানুষের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক সম্মানবোধ যদি ভেতর থেকে তৈরি হতে না পারে তাহলে কেউ যথার্থ মর্যাদা নিয়ে বাস করতে পারে না। কারণ একজনকে অসম্মান করলে নিজের মানমর্যাদাও হুমকির মুখোমুখি হয়। আর এসবই সমাজের একেবারে গভীরে গেড়ে বসে আছে। তাকে অত্যন্ত জোরালোভাবে আঘাত করতে না পারলে সঙ্কটের প্রতি বিধান আসলে কঠিন হয়ে পড়বে। নারী নয় মানুষ হিসেবে তাকে সমস্ত স্বাধীনতা আর মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করতে হবে। অসম্মান আর অমর্যাদার কঠিন নিগড়ে আটকে পড়া আমাদের দেশের মেয়েদের করুণ আখ্যান বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। প্রেমের অধিকারও কোন মেয়ের থাকে না। কোন ছেলে প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হলে মেয়েটিকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না। আর পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্তকরণে সমাজের বখাটেদের কোন জুড়িই নেই। শুধু যে তারা নিজেরা মারে তা নয় তাদের অত্যাচারে মেয়েরা নিজেও আত্মঘাতী হতে দ্বিধা করে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যায়। মৌসুমী আখতার নামে হাজারীবাগের এক পোশাক শ্রমিক ২ মে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। বাড়ির কেয়ারটেকার, দারোয়ান এবং পাড়ার কিছু বখাটে ছেলেদের উৎপাত সইতে না পেরে মেয়েটি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তারও আগে ২৯ এপ্রিল হযরত আলী নামে এক দিনমজুর তার আট বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’জনই আত্মঘাতী হয়। বরিশালের বানারীপাড়ার তিন স্কুলছাত্রী বৃষ্টি মিস্ত্রি আঁখি, সুমাইয়া আখতার এবং স্বর্ণা আক্তারকে কয়েক দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বৃষ্টিকে উদ্ধার করা গেলেও বাকি দুু’জন এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এদিকে বৃষ্টির বাবা মেয়ের সন্ধান করতে গিয়ে পথদুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তারও আগে তনু, মিতু, বুশরা, খাদিজা (সে এখন সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে), শিশু পূজা, সুরাইয়া আখতার রাইসার ওপর মর্মান্তিক আঘাত থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন এবং শেষমেশ অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার নির্মম ঘটনা আজও সাধারণ মানুষকে শিহরিত করে। অনেক ঘটনার কোন আইনি সমাধান আজ অবধি হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং দীর্ঘসূত্রতা অপরাধের মাত্রাকে প্রতিনিয়তই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে না। আর নারী ও শিশু পাচারের মতো লোমহর্ষক ঘটনাও আমাদের দেশে হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্ভোগের শিকার বিপন্ন নারীরাই এসব পাচারচক্রের আবর্তে পড়ে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যায়। যে জালে আটকা পড়ে নারীরা এই নৃশংস অবস্থার বলি হয় সেখান থেকে তাদের ফেরার পথও অনিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ অবধি মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে হয়। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যকরের অভাবে এমন একটি অসামাজিক সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার কোন পথও দেখা যাচ্ছে না। আইন আর বিচার দিয়ে কোন অসামাজিক প্রক্রিয়াকে ঠেকানো আসলেই কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে সামাজিক আন্দোলন, সচেতনতা, দায়বদ্ধতা, মানবিক মূল্যবোধ, সম্মান এবং মর্যাদাবোধ, প্রত্যেকের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া সবার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। শিক্ষিত মেয়েরাও যে নাজেহাল হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তাই শিক্ষা নারীদের সঙ্কটময় আবর্ত থেকে বের করে আনতে পারলেও তা একমাত্র সূচক নয়। গণমানুষের সুস্থ মন-মানসিকতা এক্ষেত্রে বিশেষ একটি শর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে সবার আগে একজন নারীকেই ভাবতে হবে নিজেকে নিয়ে। নিজের চারপাশে আবদ্ধ সমস্যাশঙ্কুল থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে চলার গন্তব্য ঠিক করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর মতো ঘটনাও দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসছে। সংখ্যায় তারা হাতেগোনা হলেও তাকে বাড়ানো কঠিন কোন কাজ নয়। বাবা-মাকেও এ ব্যাপারে সচেতন দায়বদ্ধতা প্রমাণ করতে হবে। বেগম রোকেয়ার একটি জ্ঞানগর্ভ বাণী বাবা-মার উদ্দেশেÑ যে অর্থ দিয়ে কোন বালিকার বিয়ে সম্পন্ন করা হয় তার অর্ধেক খরচ করলে একটি মেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। শিক্ষিত হয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়ারও পরামর্শ দিয়েছেন নারী জাগরণের এই আধুনিক পথিকৃৎ। সমাজের নানা অপসংস্কার থেকে সযতেœ নিজেকে বাঁচিয়ে চলার পথ কিভাবে শঙ্কাহীন করা যায় তার যথার্থ নির্দেশনা এই মহীয়সী নারীর জীবন দর্শন থেকে শুরু করে তার সামগ্রিক সৃষ্টিযজ্ঞে জোরালোভাবে বিধৃত আছে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×