ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজরুল

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৯ মে ২০১৭

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজরুল

আমরা সবাই জানি কাজী নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রথা বিরুদ্ধ এক কবি ধূমকেতুর মতো যার আগমন জোৎস্নার মতো তার আবার ¯িœগ্ধ অবিরল রূপ; তার এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশি অন্য হাতে রণতূর্য; সবকিছুকে যে পরোয়া করে না আবার সবকিছু যে ভালবাসে সমানভাবে। যিনি বলেন, মোর প্রিয়া হবে এসো রানী/দেবো খোঁপায় তারার ফুল; তিনিই আবার দ্রোহের কণ্ঠে বলেন- বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেইদিন হবো শান্ত- যেদিন অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না। জ্যৈষ্ঠের মতো যার দাবদাহ মূর্তি আবার কোমল হৃদয় কাতর মানব প্রেমিকার জন্য। নজরুলে মাঝে কী ছিল না- সুর, ছন্দ, প্রেম, অনুরাগ, দ্রোহ, বিরহ, মিলন, সঙ্কট, বিচ্ছেদ, প্রতিবাদ, আপোস আর সম্প্রীতির অনন্য নজির। তার ব্যক্তিজীবন যেমন ছিল বর্ণাঢ্য তেমনি তার সাহিত্য প্রতিভা বহুমুখী রসগুণে অসামান্য অবদানে ভরপুর। ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলেশান আর ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের যে প্রচ-তা তাও হয়ত নজরুলের লেখনীর ক্ষুরধার দিককে শাণিত করেছিল তার উপর ছিল দুটো বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব- সমস্ত বিশ্বজুড়ে; মানুষের মন যুদ্ধের নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার দগদগে ঘা নজরুল যুগে বয়ে নিয়ে চলছিল আর বাংলা সাহিত্যের এলিট লেখকরা ইংরেজদের সাহিত্য প্রভাবে বিমুগ্ধ আর পাঠক সমাজও সেই ধারায় বুঁদ। কিন্তু মানুষের মাঝে বিরাজমান অসিষ্ণুতার যে কীট তা তো সহজে যায় না; প্রতিটা মানুষ অবয়বে এক হলেও চিন্তা, চেতনা, চাওয়া, পাওয়া আর লাভ, ক্ষতিতে ভিন্নতর। ভিন্নতা আছে ধর্মে, বর্ণে, জাতে, পাতে, অর্থ-সম্পদে, মানসে আর আদর্শে যা বেশি মাত্রায় প্রকট ছিল তখনকার ভারতীয় উপমহাদেশে। ধনিক সমাজের প্রতিভূ উগ্র জাতীয়তাবাদের দেশ জার্মানি, ইটালি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নতুন আদর্শগত প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশেও আছড়ে পড়ল। অনেক এদেশীয় কবির মতো নজরুল তাতে আছন্ন হলেন না; তাই প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, নিরন্নের কবি নজরুল সব ভেদাভেদ দূর করতে যেমনভাবে অগ্রগামী হলেনÑ তা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। সাম্প্রদায়িক বিভেদের মূলে ধর্ম, বর্ণ যেমন বিশেষ কারণ তাছাড়াও জাতিগত বিভেদ, রাজনৈতিক লালসা, নানা মাত্রিক অর্থনৈতিক লোভ, হিংসা, সামাজিক ভিন্নতা, কায়েমি স্বার্থও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নজরুলের চেতনালোক এসব তুচ্ছ বিভেদকে কখনই ঠাঁই দেয়নি তাই তার শিল্প সৃষ্টিতে ধর্ম, বর্ণ, ও ভিন্ন রুচির মানুষকে সমান কাতারে আনতে সচেষ্ট ছিলেন নিরলসভাবে। বাংলা এবং বলা যায় বিশ্বসাহিত্যে নজরুল-ই অন্যতম কবি যাকে এসব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। এই উপমহাদেশের এই সংকীর্ণ বিষয়কে নিয়ে লড়তে হয়েছে নজরুল ছাড়া অন্য খুব কম কবিকেই। কবি নজরুলকে কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমায়িত করা যায় না। নজরুল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ খ্রীস্টান সব ধর্মের, সব সমাজের হয়ে কাজ করেছেন। তার দৃষ্টিতে মানুষের অবস্থান সবার উপরে। ধর্ম শাস্ত্র, মসজিদ-মন্দিরের চেয়ে পবিত্র মানুষ। তাই তিনি বলেন- গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। আমাদের উপমহাদেশে এক সময় মুসলিম-হিন্দুরা মিলেমিশে সমতা-সম্প্রীতে থাকত কিন্তু ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাত এই সম্প্রীতিতে চিড় ধরায়। ঔপনিবেশিক শাসন ছিল এর মূলে- ইংরেজরা আমাদের অনেক দিয়েছে; নিয়ে গেছে আরও বেশি আর সবচেয়ে যে বড় জিনিসটি নিয়ে গেছে তা হলো আমাদের আমিত্ব। যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নজরুলের অভিযাত্রা, সেই ঔপনিবেশিক শাসন দূর করার জন্য হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ছিল সর্বাগ্রে। আর নজরুলের কবিতা এতে বিরাট ভূমিকা রাখে। মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। নজরুল ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তাই বলেছেন আর মুসলিম-হিন্দুকে তিনি শুধু মুসলিম-হিন্দু হিসেবে দেখেননি তিনি মহামানবের অংশ হিসেবে দেখেছেন। নজরুলের মতো এতো বেশি প্রগতিশীল ব্যক্তি এই উপমহাদেশে আর একজনও নেই- অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ। হিন্দু না ওর মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসা কোন জন? কা-ারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! ..... কা-ারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর। উঠিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার। নজরুল নিজে বলেছেন, ‘ভারত আজ পরাধীন এবং আজও যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি, শুধু আয়োজনেরই ঘটা চলছে, এবং ঘটও ভাঙছে- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনতি দেখে অশ্রদ্ধা করে।’ ঔপনিবেশিক শাসনের কূটকৌশলের মধ্যে একটি হলো স্বদেশীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। একটি জাতি যখন নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও সংঘাত পাকিয়ে তোলে তখন সেই জাতি তার মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঐক্যমত্যে আসতে পারে না। যেটা আগে বলা হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে এই উপমহাদেশে বহু জাতি একত্রে বসবাস করে আসছিল একে অপরের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে; মুসলমানরা ভারতবর্ষে নিজেদের শাসনপ্রতিষ্ঠা করবার পর তাদের স্বার্থ নিয়ে থাকেনি এখানে সংকীর্ণতার কোন স্থান ছিল না। মুসলমানদের কাছ থেকে ইংরেজরা রাজ্য কেড়ে নিল কায়েম করল বিদেশী অপশাসন। রবীন্দ্রনাথ তার মুসলমানী গল্পে দেখিয়েছিলেন কিভাবে ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু-মুসলিম শরীরে আত্মায় এক হয়েছিল। হিন্দু আর মুসলমান যেন ছিল একই দেহে দুটি চোখ। কিন্তু ইংরেজ শাসন এসে এই দু’নয়নের মাঝে গড়ে তুলল না দেখার দেয়াল। নজরুলের কবিতায়-গানে, গল্প উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি, আচার, অনুষ্ঠান, ঐতিহ্য, চিন্তা, চেতনা ও রুচিবোধ একাকার হয়ে মিশে গেছে। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, কোরবানি, মহররম, ঈদ এসবই তার কবিতায় সমমাত্রিকতা পেয়েছে। তিনি কোরবানি নিয়ে কবিতা লিখেছেন কিন্তু সেই কবিতা ধর্মের মুদ্রা নয়। সেই কবিতা সমকালীনতা ধারণ করেছে। কোরবানির যে মূল অনুপ্রেরণা, নজরুল সেই মূল অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে জোরদার ভূমিকা পালনের কথা বলেন। কবি কোরবানি কবিতা লিখেছেন, অথচ ইসলামী শব্দকে সর্বাংশে ব্যবহার করেননি। তিনি বলেছেন, ‘আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ-সম মাল্লা খুন-বদন!’ তাই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনা করার জন্য নজরুলকে জেল খাটতে হয়েছে। এতে বোঝা যায়, এই কবিতাটি হিন্দুর কোন দেবী নয়। আর দেবীকে বোঝানো নজরুলের লক্ষ্য নয়। নজরুল অনেকখানেই ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলোকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন। নজরুল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় ভারতবাসীকে ইংরেজ শাসক না খেদানোর জন্য নির্মম কশাঘাত করেছেন। মাটির মূর্তির প্রতি নজরুলের কোন আকর্ষণ ছিল না। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের পরে নজরুলকে আটকানোর জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ফন্দি এঁটেছিল, কিন্তু এতে বেশি পুরনো প্রসঙ্গ ব্যবহার হয়েছে এবং পুরনোর আড়ালে নজরুল তার আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ পুরনো প্রসঙ্গ আনার পরেও ব্রিটিশ সরকার রেহাই দেয়নি। কেননা তার এই কবিতার বাণীতে ভিনদেশী সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ঔপনিবেশিক মনোভাবনার বীজ যখন দৃঢ়ভাবে প্রথিত তখন ভারতের হিন্দুরা মুসলিম ঐতিহ্যকে নিজের বলে ভাবতে পারেনি, তেমনি মুসলমানরাও হিন্দু সংস্কৃতিকে বেগানা সংস্কৃতি বলে জেনেছে। এই বিদ্বেষাকীর্ণ সমাজে নজরুল মিলনের এক সুস্থ বাতাস বইয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ -ভগবান, মসজিদ- মন্দির-গির্জা- ঈসা-মুসা, কৃষ্ণ, বুদ্ধ- মুহম্মদ প্রভৃতি ধর্মীয় শব্দ ঐতিহ্য প্রাণপুরুষ এবং প্রধান ব্যক্তিবর্গকে তিনি সমমাত্রায় ব্যবহার করে বাঙালী পাঠকের মানসিক সংকীর্ণতা দূর করেছেন। আরবি ফারসী শব্দ প্রয়োগে হিন্দুদের যে অনীহা ছিল নজরুল তার কাব্যে তা দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশ আসার আগে এই বিভেদ ছিল না, এমন কি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম সংস্কৃত বাংলা প-িতদের গদ্য রচনাতেও তার প্রমাণ ছিল। রামবসু প্রতাপাদিত্য চরিত লিখতে গিয়েও ফারসী শব্দের যথাযথ প্রয়োগ করেছেন। যা বিরল একটি ব্যাপার । কারণ আমরা জানি বাংলা শব্দের শুচিবাইগ্রস্ততা, মুসলমানি শব্দ-শুদ্ধিকরণ অভিযান-এসবই ঘটেছিল ইংরেজের বিভক্তি নীতির কারণে। নজরুল মুসলমানের সংকীর্ণতাকে আঘাতের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের বর্ণ বৈষম্য ছোঁয়াছুঁয়ির বিষয়কেও তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গান সম্বন্ধে ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল বলেছেন’, ১৩৩১ সালের ৩ বৈশাখ তারিখে বহরমপুরে তার বিয়ে হয়েছিল। কবির সাহিত্য ও সঙ্গীতের বন্ধু উমাপাদ ভট্টাচার্যের কাকার বাড়ি ছিল ডক্টর সান্যালের শ্বশুরবাড়ি। পরিবেশটি ছিল গোঁড়া হিন্দুয়ানি। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে এ বাড়ির নিমন্ত্রণে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থকেও আলাদা আলাদা পঙক্তিতে খেতে বসতে হতো। মুসলমানদের তো তার ত্রিসীমায়ও ঢোকার উপায় ছিল না।’ নজরুল, অনেকের মতে এই বিয়ে বাড়িতেই ‘জাতের বজ্জাতি’ গানটি রচনা করেন। তিনি সমবেত বরযাত্রীদের মাঝে গানটি গাইলেন। এটি নজরুলের জাতপাতের বিরুদ্ধে বা জাতপাতের বিভক্তি না ঘটাতে অনবদ্য একটি রচনা যদিও অনেকে গানটিকে অন্য আঙ্গিকেও বর্ণনা করে থাকেন। জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া হুকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান, তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’খান। এখন দেখিস ভারত জোড়া পচে আছিস বাসি মড়া, মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া। জানিস না, কি ধর্ম যে সে বর্মসম সহনশীল, তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়াছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল। যে জাতধর্ম ঠুনকো এত, আজ নয় কাল ভাঙবে সেত, যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ নাই পরোয়া ॥ দিনকানা সব দেখতে পাসনে দ-ে দ-ে পলে পলে, কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতাকলে। (তোরা) জাতের চাপে মারলি জাতি, সূর্য ত্যাজি নিলি বাতি, (তোদের) জাত-ভাগীরথী এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতো ধোওয়া ; বাংলা সাহিত্যে নজরুল ভিন্ন আদ্যন্ত এমন অসাম্প্রদায়িক কবি নেই। শুধু পরবর্তীকালে লালনকে আমরা জাতপাতের বিরুদ্ধে এবং একই নৃতাত্ত্বিক পরিবেশে ও পরিচয়ে বেড়ে ওঠা মানুষের শুধুমাত্র ধর্মের কারণে বিভক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখি। নজরুলের উল্লেখিত গানটির সঙ্গে লালনের জাত গেল জাত গেল গান ও আরও অন্য অনেক গানের সাযুজ্য পাওয়া যায়। নজরুল মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। লালনের মাঝেও যা সম্যকভাবে পাওয়া যায়। নজরুলে কবিতা আর সংগ্রাম একই অর্থবোধক। হিন্দুর মুক্তি কাকে বলে, মুসলমানের মুক্তি কাকে বলে সে সব তিনি বুঝতেন না। তিনি বুঝতেন, এদেশ স্বাধীন হবে, মাটির পৃথিবীর মানুষের মধ্যে বৈষম্য কমে যাবে। মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবে। নজরুল তার অসামান্য কবিতা ‘হিন্দু-মুসলিম’ এ অসাধারণভাবে হিন্দু-মুসলিমদের মিত্রতার স্বপ্নজাল বুনেছেন- মাভৈঃ! মাভৈঃ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ, সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান-গোরস্তা! ছিল যারা চির-মর-আহত, উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা-জাগ্রত, খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোড়ে বাণ। জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান!’ আবার তার অম্লান উচ্চারণ- মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। ‘স্বামী বিবেকানন্দ খুব চমৎকারভাবে এ বিভেদ ভুলে বলেছেন- ভারতে যেদিন হইতে এইÑম্লেচ্ছ’ শব্দটির উৎপত্তি সে দিন হইতে ভারতের পতন; মুসলমান আগমনে নয়। মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায় যে ধর্ম, তাহা আর যাহাই হউক ধর্ম নয়। নজরুলের সবচেয়ে বড় সাধনা ছিল মানুষ হওয়া। ‘শাস্ত্র শকুন’ নির্দেশিত সাম্প্রদায়িক মানুষ হওয়া নয়। নজরুলের অসাধারণ মানবীয় উচ্চারণ- ‘হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগনতলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া মানব! তোমার কণ্ঠের সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি; বল দেখি, ‘আমার মানুষ ধর্ম’ দেখিবে, দশ দিকে সার্বভৌম সাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁদিয়া উঠিতেছে। মানবতার এই মহাযুগে একবার গ-ি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বলো, যে তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ তুমি ধ্রুব সত্য!’ (ছুৎমার্গঃ যুগের বাণী) সাম্যবাদী চেতনা নজরুল বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বাবার সঙ্গে এক্ষেত্রে নজরুলের বাবার মিল ছিল। রবীন্দ্রনাথের বাবা কবি হাফিজের বিরাট ভক্ত ছিলেন; তিনি তার বৌ-মাদের মাঝে প্রতিযোগিতা করতেন, যে কবি হাফিজের কোন কবিতা বা গান তাকে পুরোটা শুনাতে পারতেন তাকে সোনার বালা উপহার দিতেন আর অন্যদিকে নজরুলের বাবা অত্যন্ত ধার্মিক হয়েও নজরুলের কুরান, হাদিস থেকে পুরান, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত জানতে বা লেটোর দলে গান করতে বাধা দিতেন না। এভাবেই নজরুল উদারনৈতিক মানবতাবোধ অর্জন করেছিলেন। নজরুল ইসলাম সমান দক্ষতার সঙ্গে ইসলামী গান এবং শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। আধুনিক বাংলা কাব্যে এমনটি আর কেউ করেননি। শাক্ত পদাবলির ইতিহাসে নজরুল নিজের জন্য একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে নজরুলের উদাহরণ কেবল নজরুলই। ইসলামী সঙ্গীতে নিবেদিত এই কবি শক্তি উপাসনার এত ভক্তি নজরুল কোথা থেকে পেয়েছিলেন তা আমাদের বিস্মিত করে। নজরুল না এলে আল্লাহভক্ত বাঙালী এবং কালীভক্ত বাঙালী তাদের প্রাণের ভাষা খুঁজে পেতেন অল্প। একই সঙ্গে তিনি লিখছেন- ১. বলরে জবা বল কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল ॥ আবার ২. মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে তাই কি রে তোর কণ্ঠেরই গান এতই মধুর লাগে। নজরুল জানতেন মুসলমান-হিন্দুর মিলন ছাড়া এই উপমহাদেশের এগিয়ে যাওয়া পদে পদে বিঘিœত হবে নজরুল নির্ভীকভাবে বলেন, ‘আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দুদের দেবদেবীর নাম নিই ’ (ইব্রাহিম খাঁকে লিখিত পত্র) নজরুল কবিতা ছাড়াও নিজের জীবন থেকে শুরু করে অন্যান্য সাহিত্য কর্মেও হিন্দু-মুসলমান এবং অন্যান্য সম্প্রদায়কে সমন্বিত করার চেষ্টা হয়েছে। তিনি তার গল্প উপন্যাসে উভয় সম্প্রদায়ের পাত্রপাত্রীকে নায়ক-নায়িকা এবং অন্যান্য চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন। তার ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে জটিল প্রেমকাহিনী হিন্দু-মুসলমান নায়ক-নায়িকাদের ঘিরে গড়ে উঠেছে। জাহাঙ্গীরের প্রমত্ত বজ্রপাণি একই সঙ্গে স্বাধীনতার সংগ্রামে জড়িত। যদিও সন্ত্রাসী আন্দোলনে তৎকালে মুসলমান যুবকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু নজরুল তার উপন্যাসে সেই গ-ি ভেঙ্গে দিয়েছেন। এই উপন্যাসে প্রমত্ত বলেন, ‘আমার ভারতবর্ষ-ভারতের এই মূক, দরিদ্র, নিরন্ন পর পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। - আমার ভারতবর্ষ ইন্ডিয়া নয়, হিন্দুস্তান নয়, গাছপালার ভারতবর্ষ নয়, আমার ভারতবর্ষ। আমার ভারতবর্ষ যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন তীর্থ কত অশ্রু-সাগরে চড়া পড়ে গড়ে উঠল আমার এই বেদনার ভারতবর্ষ। ওরে, এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়, এ আমার মানুষের মহাভারত।’ জাহাঙ্গীরের এই কথাগুলো দিয়ে নজরুল এক বিভেদহীন উপমহাদেশের চিন্তা করেছিলেন- কিন্তু আজ আমরা এতো বছর পর এসে দেখি নজরুলের এই কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি- মহামতি নজরুলের মিত্রতার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেছে- তাই আমাদের এই উপমহাদেশের প্রধান সাতটি দেশের আন্তঃবাণিজ্য মাত্র ৩% যেখানে আসিয়ানের ৪৭% আর ইউরোর ৬০% এর বেশি। ইংরেজরা যে সন্দেহ, ভয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ঘৃণা আমাদের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে গেছে তা থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি কিংবা এটা আমাদের নিজেদেরই সৃষ্ট বিভেদ। নজরুল জানতেন নির্যাতিতের জাতি নেই, সে যে ধর্মেরই হোক। নিপীড়িত হিন্দু এবং নিপীড়িত মুসলমানের মধ্যে কোন তফাত নেই। গরিব মুসলমান এবং গরিব হিন্দুর দুঃখ-বেদনা এবং শিল্পবোধ প্রায় একই মাত্রায়। আবার ধনী হিন্দু এবং ধনী মুসলমান উভয়ের বাড়িতেই দামী আসবাবপত্র, অমূল্য সব পেইন্টিং ভরা। নজরুল তাই ধর্মনিরপেক্ষ সেই নির্যাতিত মানুষকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অঙ্কিত করেছেন। মানবের এমন সাম্যের দার্শনিক চেতনা আমাদের মধ্যযুগের বাউল দার্শনিকগণের ছাড়া আর কারও ছিল না। যে মানবতা প্রচার করেছিলেন লালন; নজরুলের মনের সমৃদ্ধি লালনেরই অনুরূপ। কিন্তু লালন শারীরিক সংঘর্ষ এবং সংগ্রামকে এড়িয়ে গেছেন। নজরুল মানুষের কল্যাণ আর মুক্তির জন্য সেই পথকেও বেছে নিয়েছেন। নজরুলের মানবতা তাই আর সবার থেকে শ্রেষ্ঠতর। এমনকি আমাদের মধ্যযুগের মানবতাবাদী বাউল দার্শনিকদের চেয়েও। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৃথিবীর সবখানেই বিরাজমান। এই দাঙ্গা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই চলছে। প্রকৃতপক্ষে এই দাঙ্গার কারণও প্রধানত অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতা দখলের লালসা। এই লেখা যখন রচিত হচ্ছে ঠিক সেই সময় প্যালেস্টাইন, লিবিয়া, সিরিয়া আরও অন্যান্য দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। এই যুদ্ধের বাইরের রূপটি মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। আমরা দেখেছি কী নিষ্ঠুরভাবে নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গোতে মানবতার চরম রক্তক্ষরণ ঘটেছে কিন্তু তারা ছিল একই জাতিগোষ্ঠীর লোকজন; সামান্য বিভেদ নৃশংস ও নিষ্ঠুরভাবে মানুষের জীবননাশ ঘটিয়েছে। মানুষ নির্বিচারে পরস্পরকে হত্যা করেছে। মানুষকে হত্যা করার জন্য উন্নত দেশগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে অত্যন্ত ভয়ানক ও প্রাণঘাতী ভয়ঙ্কর অস্ত্র। শস্য উৎপাদনের জন্য যতনা অর্থ বরাদ্দ হয় তারচেয়ে অস্ত্র তৈরি করার জন্যে আধুনিক সভ্যতা বেশি অর্থ খরচ করে। মানুষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে, পায়ে পিষ্ট করে মারছে বা জীবন্ত কবর দিচ্ছে। এ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু এবং নারীরাও। অধিকতর শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েমী স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং ধর্মগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক চেতনা ও সংঘাত উস্কে দিচ্ছে। এটা ফায়দা লোটার একটা অপ-কৌশল। পৃথিবী যত প্রযুক্তি, বিজ্ঞান আর আধুনিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনের সঙ্কট আরও গভীরতর হচ্ছে এই সময় নজরুলের মতো একজন কবির উপযোগিতা তাই কখনও ফুরিয়ে যায় না। যখনই পরাধীনতা, যখনই নির্যাতন আর সাম্প্রদায়িক কূপম-ূকতা মানুষের বিবেককে দখল করে নেয়; তখনই নজরুল গুরুত্বপূর্ণ হন। উইলিয়াম ব্লেক শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন ফ্রেঞ্চ রেভুলেশান এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন কবিতা লিখেিেছলেন- যেখানে চার্চের সমালোচনা আছে, সামাজিক, মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে, দুর্বলকে শোষণের তীব্র প্রতিবাদ আছে, আবার এডওয়ার্ড বার্গাট ডুয়েট ডু রয়েস কালোদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন- কিন্তু নজরুলের মতো এতো কালজয়ী ও অসংখ্য কবিতা কেউ লিখে যেতে পারেননি। তাই মানবিক বিপর্যয়ের এই ক্রান্তিকালে, পশুত্বের বিভীষিকাময় ক্ষণে, উগ্রপন্থার উত্থানে, নিদারুণ চেতনার অবক্ষয়ে নজরুলের কবিতা অনুবাদ করে মানবতার সঙ্কট উত্তরণে এবং অসহায় ও নিপীড়িতের জন্য নিরাপত্তা আর মৃতপ্রায় বিবেক জাগ্রত করার সময় আবার এসেছে। হেনরিক ইবসেনের ডল্স হাউস বা মাদার কারেজ এ্যান্ড হার চিলড্রেন যেমন ইউরোপজুড়ে মানুষের মনকে নাড়িয়ে দিয়ে তাদের বিভিন্ন মাত্রার মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য মানুষের প্রেরণা হয়েছিল- নজরুলের প্রেরণাদায়ক, মানবপ্রেমী, সম্প্রীতি আর জাগরণের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে আবার উপস্থাপন করতে হবে- আমাদের সচেতনতার জন্যে, নব উদ্দীপনার জন্য, সমতার জন্য, মঙ্গলের জন্য, আর নিরাপত্তার জন্য।
×