ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৯ মে ২০১৭

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন

(গত মঙ্গলবারের পর) ভাবনার জগতে লালনগীতি শুনতে শুনতে মনে হলো, সত্যি কি সারাজীবন তার আমরা কোন কিছু অন্তরের অন্তস্তলে জানতে পারি। আবার লালনগীতির আরেকটি গান শুনতে শুনতে মনে হলে ‘কি এক অচিন পাখি পুষলাম খাঁচায়, হলো না জনম ভরে তার পরিচয়।’ জনম ভরে দু’জন মানব-মানবী পাশাপাশি বসবাস করতে পারে কিন্তু এক জনের সঙ্গে আরেক মনের কি মিলন ঘটে থাকে? মানুষ মানুষের জন্য, তবে আত্মার পরিচয় আর নৈকট্যই সবচেয়ে বড়- দৈহিক সম্পর্কের স্বল্পকালীন মূল্য হয়ত কারও কারোর কাছে থাকতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এ কারণেই সম্পর্ক গাঢ় হয় যখন মনের মিলন ঘটে থাকে। ক্ষণস্থায়ী এ নশ্বর জীবনকে ভালবাসার ছোঁয়ায় আপ্লুত করতে হয়Ñ জীবনকে সুন্দর করতে হয়। এ জন্য জীবনের গভীরতা বুঝতে হয়- মানবিকতায় সমুজ্জ্বল হতে হয়। লালন মাজার থেকে বেরিয়ে জাতির জনক ও বঙ্গবন্ধু কন্যার চিত্র এবং সুভ্যানির দেখলাম তখন বেশ ভাল লাগল। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায় গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। জেলা পরিষদের সাইন বোর্ড ছাড়া আর কিছু নেই। মনে পড়ল, আমার বাবা মোবাশ্বের আলী সাহিত্য-সমালোচনা, অনুবাদ কর্ম করেছেন অথচ একুশে পদক পাওয়া সত্ত্বেও নিয়ম থাকা সত্ত্বেও তার মিরপুরের অস্থায়ী কবরস্থানে তাঁর কবরস্থানটি স্থায়ী করার অনুমতি দেয়নি সিটি কর্পোরেশন অথচ ২০০৫-এর পর যারা মারা গেলেন, তারা কিন্তু পারমিশন পেয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ওপর চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, নজরুলের ওপর ছয়টি আর মধুসূদনের ওপর চারটি আকরিক গ্রন্থ রচনা সত্ত্বেও মোবাশ্বের আলীর নাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অন্য কোন স্থানে হয়নি। এমনকি ভাষাসৈনিক হিসেবেও কোন সড়কের নাম কুমিল্লা অথবা কোথাও দেয়া হয়নি। রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাশ্বের আলীর নামে একটি চেয়ার প্রবর্তনের আবেদন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখছি। তাঁর রচিত ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গকৃত (দৃষ্টব্য : মোবাশ্বের আলী, বাংলাদেশের সন্ধানে, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ২০১৭)। আজকাল নিজের কাছে ধাক্কা লাগে। যাকে জামায়াতের নামে ছাত্রছাত্রীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছিলাম। যিনি পাবনায় তার পরমাত্মীয় জামায়াতের আমিরের পরামর্শ মতো চলত, সে যখন শুনি গিরগিটির মতো রং বদলিয়ে আওয়ামী লীগার সেজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে। যতদূর জানি তত্ত্বাবধায়কের সময়েও জামায়াত কানেকশন লাগিয়ে চাকরি পেয়েছিল। এ ধরনের গিরগিটিকে চিহ্নিত করা দরকার। আবার রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যিনি কথায় কথায় ইভটিজিং বলতে অভ্যস্ত, তিনি কোন শাস্তি পাননি। ভাবলাম কুষ্টিয়ায় যখন এসেছি, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সাধারণ সদস্য হিসেবে দুটো এনজিও অন্তত পরিদর্শন করে যাই। বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুটো এনজিও পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। ১১ মে কুষ্টিয়ায় সেবা (পল্লী উন্নয়ন কুঠির) ছাড়া কুঠির, হাউজিং, এস্টেট, কুষ্টিয়া পরিদর্শন করলাম। দেখলাম হতদরিদ্র ও অনাথ যুবক-যুবতী এবং আদিবাসীদের জন্য ছয় মাসব্যাপী দু’ধরনের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স শামসুল আলম স্বপনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। একজন ছাত্রী আশার কথা শোনাল-প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই আউট সোর্সিংয়ের কাজ পেয়েছে। স্বপন সাহেব আবার বিএনএফের নামে বাগান লাগিয়েছেন। বিএনএফের অবশ্য কিস্তির পরিমাণ খুব স্বল্প। এটির পরিমাণ বাড়ানো গেলে উপকারভোগীরা আরও উপকৃত হতো। তবে হাওড় এলাকায় বিএনএফ পরিকল্পিত উপায়ে অধিকতর গঠনমূলক কাজ করতে পারত। বিএনএফের দেয়া পরিকল্পনা অনুসারে ১২ তারিখ বিকেলে ‘সেভিয়ার’ রেল রোড, যশোরের উপকারভোগীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়। উপকারভোগীরা সামান্য অর্থায়নে অসামান্য সব কাজ করে চলেছেন। উপকারভোগীদের কথা থেকে সুস্পষ্ট যে, তারা যে সব ব্যাগ, নকশীকাঁথা, চাদর, টেবিলমেট, সোফারমেট বানাচ্ছে তাতে আরও বেশি দাম পেতেন যদি কিনা তারা বিপণন ও বাজারজাতকরণের সুযোগ-সবিধা বিএনএফ থেকে পেতেন। কিন্তু বিএনএফের চার্টারে অবশ্য বিপণন ও বাজারজাতকরণের কোন ব্যবস্থা নেই। এদিকে সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আসলে অল্প অর্থের মাধ্যমে যে জীবনমান উন্নত করা যায় সেটির বড় প্রমাণ হচ্ছে বিএনএফ। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিএনএফের কাজকর্মে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে সামান্য অর্থ সাহায্যে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরামর্শ মানুষের দারিদ্র্যের দুঃসহ যাতনা থেকে মুক্তির পথ যোগায়। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে সংগ্রহ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে রূপান্তরের জন্য সামাজিক যোগাযোগ ও কমিউনিটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা গ্রামীণ এলাকায় গ্রহণ করা দরকার। এ লক্ষ্যে অষ্টম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় একটি বিশেষ নিবন্ধ ও নির্দেশিকা থাকতে পারে। ইতোমধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মাইক্রোক্রেডিট তেমন লাভ হয় না। বিএনএফ সম্পর্কে আরও দুটো তথ্য দিতে চাই- গবেষণা করে দেখেছি বিএনএফের অর্থায়নের মাধ্যমে এসডিজি-১ লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি এবং এসডিজি-৫ লক্ষ্য হচ্ছে নারী-পুরুষ সমতা বিধানে কাজ করে চলেছে। বিএনএফকে সরকার কর্তৃক অর্থায়নের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচীতে লাগাতে হবে। কুষ্টিয়া শহরকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে ঢেলে সাজানো দরকার। শিল্প নগরী হিসেবে গড়তে হলে অবশ্যই একটি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। এনজিওগুলো যাতে দেশের হতদরিদ্র মানুষের পাশে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার কোন কোন এনজিও ১০-১২ তলা করে কেবল ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। যেমন ‘দিশা’ নামের এনজিও হোটেল রেস্তরাঁর নামে বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য কুষ্টিয়ায় ফেঁদে বসেছে। তাদের হাত হয়ত লম্বা। তবে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে যারা দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্রে আছে তাদের হাত থেকে বাঁচাতে এনজিওদের কাজ করতে হবে। অবশ্যই বেনিয়া বৃত্তিতে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত নয়। এদিকে যশোর বিমানবন্দর থেকে আসার দিন অর্থাৎ ১২ মে বিপত্তি ঘটল। বাংলাদেশ বিমান যথারীতি কোন কারণ ছাড়াই প্রায় দেড় ঘণ্টা বিলম্বে এলো। জাতীয় বিমানের সিডিউল বিপর্যয় নতুন নয়। দুষ্ট লোকে বলে অন্যকথা- আগে বিশেষত এরশাদ আমলে বেসরকারী খাতের বাসের সময়সূচীর জন্য ট্রেনের সময়সূচী পরিবর্তন করা হতো। আর এখন বেসরকারী বিমানের জন্য জাতীয় বিমানের সময়সূচী পরিবর্তন করা হয় বলে দুষ্ট লোকেরা বলাবলি করছিল। বিমানে যে, নাশতা দেয়া হয় তার ক্ষেত্রে যাদের ডায়াবেটিস আছে সেটি লক্ষ্য রেখে মিষ্টি জাতীয় জিনিস না দেয়াই ভাল। আর পানির বোতলের সাইজ দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। যশোর বিমানবন্দরের দৈন্যদশা দেখে মনে হয়েছে এটিকে কি পাবলিক, প্রাইভেট পাটনারশিপের আওতায় বর্ধিত করা যায় না। কুষ্টিয়াতে অবিলম্বে একটি বিমানবন্দর স্থাপন করা উচিত। সেখানকার বিমানবন্দর স্থাপিত হলে পর্যটকরা সহজে রবীন্দ্রনাথ, লালন ও মীর মশাররফ হোসেনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে পারবেন। খারাপ লাগে ব্রিটিশ আমল থেকে কুমিল্লায় বিমানবন্দর থাকলেও জিয়ার আমলে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ঢুলিপাড়ায় গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কুমিল্লা বিমানবন্দরটি অবিলম্বে চালুর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানাচ্ছি। দরকার হলে পর্যটন মন্ত্রণালয় বেসরকারী উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানাতে পারে। আরেকটি কথা না বললেই নয়- কুষ্টিয়ার গড়াই নদীটি মৃতপ্রায়। এটির ড্রেজিং করার পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনা দূর করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যাতে সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন তাদের সুখ-দুঃখের কথা ভাবেন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার আদর্শ বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকেন সে জন্য জোর তৎপর হতে হবে। নেত্রীর নেতৃত্বগুণে দেশ এগিয়ে চলেছে- কিন্তু যারা মধ্যম পর্যায়ে থেকে তৃণমূলের সঙ্গে সংযোগ রাখছেন না তাদের ব্যাপারে অবশ্যই দল খেয়াল রাখবে। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ [email protected]
×