ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

দ্রব্যমূল্য, ব্যাংক পরিচালক ও আমদানি-রফতানির বিচিত্র খবর

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৯ মে ২০১৭

দ্রব্যমূল্য, ব্যাংক পরিচালক ও আমদানি-রফতানির বিচিত্র খবর

অর্থনৈতিক খবর আছে বেশ কয়েকটি যার ওপর লেখা যায়। যেমন ব্যাংক পরিচালকদের ওপর হচ্ছে একটি। দ্বিতীয় একটি খবর হচ্ছে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টের’ ওপর। তৃতীয় খবরটি দ্রব্যমূল্যের ওপর। এ ছাড়াও খবর আছে। তবে সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির খবরটি হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গত সপ্তাহের শেষের দিকের কথা। বাজারে গিয়ে দেখি সমস্ত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। বেড়েছে মানে ভালভাবেই বেড়েছে। আরও খবর নিয়ে দেখি চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, ছোলা ইত্যাদির দামও বেশ বেড়েছে। হঠাৎ এই বৃদ্ধি কেন? সরবরাহে ঘাটতি হয়েছে? আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে? ডলারের দাম বেড়েছে? দেখা যাচ্ছে এর কোনটাই সত্যি নয়। সামনে রোজার মাস এটা একটা খবর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন বাজেট আসছে জুন মাসের প্রথমেই। শোনা যাচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়া মাত্রই সমস্ত জিনিসের দাম বাড়বে। কারণ ভ্যাট হার হবে ১৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা কী তাই আগেভাগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিল? ডলারের দাম দু’-একটা ‘দুষ্ট’ ব্যাংক বিনা কারণে হঠাৎ বাড়িয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়েনি। পণ্য সরবরাহ কম তো নয়ই, বরং খবরের কাগজে প্রকাশিত আমদানির তথ্যে দেখা যাচ্ছে অনেক পণ্যের সরবরাহ বরং চাহিদার চেয়ে বেশি। চালের দাম হঠাৎ বাড়ছে কেন? সরকারের গুদামে চাল আছে। সরকার খোলা বাজারে চাল বিক্রি করছে। অকাল বন্যায় আক্রান্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের সাত জেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহে কোন ঘাটতি নেই। এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি জারি করেছেন অনেক আগেই। রোজা উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের পণ্যমূল্য নিয়ে খেলতে দেয়া হবে নাÑ এই হচ্ছে তার বক্তব্য। কিন্তু সকল আশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছেই। এর পরিণতি কী তা আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। বরাবর ব্যবসায়ীরা যা করেন এবারও তারা তাই করছেন। অথচ এর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেই। বলা হয় বাজার অর্থনীতির কথা। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন বাজার অর্থনীতিতে সরকারের করণীয় নেই। সরবরাহ ঠিক রাখা তো সরকারের দায়িত্ব। সরবরাহ ঠিক আছে বলা হচ্ছে। তাহলে মূল্যবৃদ্ধি কেন? চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সমান, কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি। এমতাবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? এটা কোন্ ধরনের বাজার অর্থনীতি? আর এটাই যদি বাজার অর্থনীতি হয় যেখানে অর্থনীতির কোন নিয়ম রক্ষিত হবে না। তাহলে সরকারের অধিকার আছে হস্তক্ষেপ করার। তবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাই যদি ‘সরকার’ বনে যায় তাহলে বলার কিছু নেই। যেমন কথা উঠেছে ব্যাংকের পরিচালক নিয়ে। কেউ কেউ বলেই ফেলছেন প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনে রদবদল করা হচ্ছে। কী করা হচ্ছে? আগে ব্যাংক পরিচালকরা একনাগাড়ে ৬ বছর পরিচালক থাকতে পারতেন। এখন থাকতে পারবেন ৯ বছর। প্রতি পরিবার থেকে এখন দুজনের পরিবর্তে থাকতে পারবেন ৪ জন। এতেই উঠেছে অভিযোগ। অবশ্য বিধানটি সবেমাত্র মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। সংসদে যাবে, বিতর্ক হবে। পরে পাস হলে হবে আইন। বলা হচ্ছে ব্যাংকগুলো পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দেশে বর্তমানে ৪০টির মতো বেসরকারী ব্যাংক আছে। এই মুহূর্তে যখন নতুন বিধান এখনও কার্যকর হয়নি তখন কী বেসরকারী ব্যাংকগুলো পরিবারের নিয়ন্ত্রণে নয়? আমরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে, একেকটি ব্যাংক দু-একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে নয়? সবাই তো বিষয়টি জানে। তারপরেও প্রশ্ন আছে। পরিচালকের সংখ্যা পরিবার থেকে যাই হোক না কেন তারা সম্মিলিতভাবে ১০ শতাংশের বেশি ভোটের মালিক হবেন না। এই বিধানটি কী পরিবর্তন হয়েছে? আমার জানা নেই। ছয় বছরের জায়গায় ৯ বছর হয়েছে। বর্তমান বিধান মোতাবেক ছয় বছর পর পরিচালকরা তাদের জায়গায় কাকে পরিচালক হিসেবে মনোনীত করতেন? বাইরে কাউকে? নিশ্চয়ই নয়। ছয় বছর পর পরিচালক তো পরিচালক থাকছেন না। কিন্তু তিনি কী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন? নিশ্চয়ই নয়। তার শেয়ার যখন থাকবে তাই তার মনোনীত লোকই নতুন পরিচালক হবেন- তাই নয় কী? সেই স্থলে ৯ বছরী পরিচালক অধিকন্তু কী ক্ষতি করবে এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। এই সকল বিষয় যেমন ভালভাবে আলোচনা হওয়া দরকার, তেমনি আরও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার অন্য একটি বিষয়। বাস্তবে পরিবার, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের পরিচালকের সংখ্যা যাই হোক না কেন তারা কোন অনিষ্ট করতে পারবে না, যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কঠোরতর থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা হওয়া দরকার নিñিদ্র। তার চেয়ে বড় কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ‘ক্ষমতা’ আছে তা যদি তারা সময়মতো প্রয়োগ করে তাহলে পারিবারিক পরিচালকরাও ব্যাংকের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কোন পরিচালক, কয়েকজন পরিচালক, চেয়ারম্যান প্রমুখ যদি ব্যাংকের ক্ষতি করে বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বহিষ্কার করতে পারে। ব্যাংকের বোর্ড বাতিল করতে পারে। ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা খর্ব করতে পারে। এসব কেন করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক? যখন ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন’ ছিল না তখন অনিয়মের জন্য হরেদরে পরিচালকদের বিদায় করা হয়েছে। অথচ এখন কেন তা করা হবে না? কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ক্ষমতা প্রয়োগে কঠোর হলে এবং তার ক্ষমতা প্রয়োগ নির্বিঘœ হলে ব্যাংকে ব্যাংকে ‘শয়তানি’ করা সত্যি অসম্ভব হবে। এসবের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা আছে। আসলে আমাদের দরকার ছিল ‘ব্যাংকিং কমিশন’, যার অঙ্গীকার আছে অর্থমন্ত্রীর। কমিশন যদি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করত এবং সেই মোতাবেক কাজ হতো তাহলে কথা কম হতো। এখন সরকার এবং ‘মিডিয়া’ ব্যাংকগুলোকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। নিরপেক্ষভাবে কোন কথা বলা বড়ই মুশকিল। সস্তা কথার দাম বেশি। ‘লোকপ্রিয়’ কথার দাম বেশি। বিদ্যমান আইনের ভেতরেই যে বিশেষ একটা মহল-গোষ্ঠী কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে তার কথা ‘মিডিয়া’ বলছে না কেন? তার কথা ‘প-িতরা’ আলোচনা করছেন কেন? ‘সিলেকটিভ’ পন্থায় সমালোচনা করা আমাদের মজ্জাগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা দরকার প্রথমে, তারপর নতুন আইন বা তা সংশোধন করা দরকার। এটা করলে জনমনে কোন প্রশ্ন থাকবে না। ওই যে বললাম আমরা ‘সিলেকটিভ’ভাবে কথা বলিÑ যেমন অর্থ পাচার। চারদিকে হৈচৈ, টাকা পাচার হচ্ছে। এটাই খবর হয় প্রায় প্রতিদিন। ভীষণ ক্ষোভ ও হতাশার খবর কতবার যে এর ওপর লিখেছি তার কোন হিসাব নেই। অথচ এখন খবর দেয়া হচ্ছে উল্টো। গরম খবরে জল ঢেলে দেয়ার মতো অবস্থা। এসব খবর দেয় ‘ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি’ বলে একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা। এবার এরা বলছে ২০১৬ সালে যত টাকা বাংলাদেশ থেকে বাইরে পাচার হয়েছে তার দেড়গুণ টাকা বাংলাদেশে পাচার হয়ে এসেছে। কই কেউ তো এটা নিয়ে আলোচনা করছেন না। টাকা যে পাখির মতো এর কথা তো কেউ বলছেন না। ধমক দিলে তা উড়ে যাবে অন্যত্র। ‘আদর’ করলে পাখি (টাকা) ফিরে আসবে খাঁচায়। এসব আলোচনা কেউ করেন না। সব জিনিসেরই যে দুটো লক্ষ্য থাকে তার আলোচনা দেশে কম। এই যেমন রফতানি। কাগজ খুললেই শুধু রফতানির কথা। রফতানি কত বাড়ল, মাসে মাসে কত বাড়ল শুধু এসব খবর। কই গুরুত্ব দিয়ে কী আলোচনা হচ্ছে যে, এই রফতানি পোশাক রফতানি, অন্য রফতানি নেই। আরও প্রশ্ন, এই রফতানির বিপরীতে যে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদনি হচ্ছে তার ওপর আলোচনা কই। পণ্য রফতানি নয়, শুধু রয়েছে সেবা আমদানি এবং সেবা রফতানি। হিসাবে আমাদের আমদানি অনেক বেশি, রফতানি বেশ কম। একইভাবে সেবা আমদানি বেশি, সেবা রফতানি বেশি। এর জন্য দুটো হিসাব করতে হয়। একটা হচ্ছে ‘ব্যালেন্স অব ট্রেড’, আরেকটা হচ্ছে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’। ‘ব্যালেন্স অব ট্রেডে’ পাওয়া ঘাটতির খবর। পণ্য আমদানি এবং রফতানিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ঘাটতি বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। এর অর্থ আমদানি যেভাবে বাড়ছে সেভাবে রফতানি বাড়ছে না। একইভাবে সেবার ক্ষেত্রেও তাই। অতএব ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টে’ দুই বছর পর এই প্রথম বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। এর প্রধান কারণ রেমিটেন্স হ্রাস। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসাররা বিদেশে গিয়েছিলেন। তারা বলছেন প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছে বিকাশে। খুবই দ্রুত পরিশোধ ব্যবস্থা ‘বিকাশ’-এ। তাহলে উপায়? ‘বিকাশ’ ব্যবস্থা বন্ধ করা? না, ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোকে দ্রুততর করা এবং লাভজনক করা? ওইদিন কাগজে দেখলাম ভারতেও রেমিটেন্স অনেক হ্রাস পেয়েছে। এর কারণও কী ‘বিকাশের’ মতো ব্যবস্থা। অনেকে মনে করেন তা নয়। তাহলে প্রকৃত কারণ কী? সম্ভবত ঈশ্বর জানেন। তবে আপাতত কথা হচ্ছে অর্থনীতির খবরগুলো মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকারের সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×