ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভগীরথীর সন্তানের এক পাটি জুতো -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৮ মে ২০১৭

ভগীরথীর সন্তানের এক পাটি জুতো -স্বদেশ রায়

শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েদের সেই অবস্থান নেয়ার সময়টা একটা আলাদা সময় ছিল বাংলাদেশে। জানি না এত সুন্দর সময় আমাদের জীবদ্দশায় আর দেখতে পাব কিনা! ভোরের সূর্যের আলোয় প্রতিদিন সকালের হাঁটা সেরে দেখতে যেতাম ওদের। প্রতিটি সন্তানের মুখ মনে হতো যেন নতুন কিছু। কোন এক আনন্দলোক থেকে ওরা নেমে এসেছে পৃথিবীতে। আসলে মানুষকে কখনও কখনও বড় বেশি ভাল লাগে। একাত্তরে আমরা ক’ভাই একদিন বসিরহাটের একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে, হঠাৎ শুনতে পেলাম মুক্তিযোদ্ধারা যাচ্ছে। দৌঁড়ে গেলাম ওদের দেখতে। মুখে দাঁড়ি, চুল একটু লম্বা, হাতে অস্ত্র। কি অদ্ভুত যে দেখাচ্ছিল ওঁদের ! আমার যে ভাইটি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে মারা গেছে। ও বেঁচে থাকতে কতদিন যে ওকে বলেছি, ওদের সত্যি অন্যরকম দেখাচ্ছিল। আর সত্যি বলতে কি, যখনই শুনি এই লোকটি রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল, কেমন যেন তার শরীরটা, চোখগুলো একটা হায়েনার মতো কদর্য হয়ে ওঠে চোখের সামনে। তার দিকে তাকাতেও ঘৃণা করে। মনকে আনন্দিত করার জন্যে, মনকে সুন্দর করার জন্যে এখনও তাই মাঝে মাঝে মনে করি গণজাগরণ মঞ্চের সেই কচি মুখগুলোকে। যেমন সোমবার থেকে একটি সন্তানের মুখ বার বার মনে পড়ছে। সকালের আলো তখনও উত্তাপ ছড়ায়নি। গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও কম। তারা সবাই মিলে গোল একটি বেষ্টনী তৈরি করেছে। ওই বেষ্টনী ঠেলে হঠাৎ একটি তরুণ ঢুকলো। ঢুকেই সে তার সমস্ত শরীর ও মন প্রাণ দিয়ে এক নতুন স্লোগান ধরল। তার স্লোগান ছিল, “আমার মা বীরাঙ্গনা, আমি কোন আপোস জানি না।” ছেলেটির স্লোগানের স্বরে মুহূর্তে যেন বদলে গেল গোটা শাহবাগ। যারা আমরা পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, কেউ চোখের পানি আটকাতে পারছিলাম না, নতুন প্রজন্মের এই গর্বিত উচ্চারণ শুনে। কারণ, আমাদের এই মু্িক্তযুদ্ধে সাড়ে ছয় লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়ে আমাদের ইজ্জত রক্ষা করেছে। আমরা কেউ তাঁদের মা বা বোন বলে ডাকিনি। তাঁরা সমাজের আবডালে, আড়ালে মুখ লুকিয়ে বেঁচেও মরে ছিল বা আছে। তারপর আরেকবার মরে গিয়ে জন্মের মতো বেঁচেছে। সত্যিকার অর্থে এ সমাজ তাঁদের একটি মাত্র স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ওদের সকলের পিতার নাম লিখে দাও- শেখ মুজিবুর রহমান। তাই এ সমাজে বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে, তাঁদের স্বীকৃতি শুধু এটুকু- তাঁরা শেখ মুজিবের মেয়ে। আসলে তাঁরা শেখ মুজিবের মেয়ে না হলে কি দেশের স্বাধীনতার জন্যে নারীর জীবনের সব থেকে সুরক্ষিত ধন খোয়াতে পারে? ১৯৭২ থেকে ২০১৩ তে এসে যখন দেখলাম জাতির জনক যাদের নিজের মেয়ে বলেছিল, এই তরুণ প্রজন্ম তাদের ‘মা’ বলে ডাকছে. সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ইতিহাস তাহলে সত্যকে এমনি করেই উর্ধে তুলে ধরে। ওই তরুণের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আজ যদিও না হয় কোন একদিন, নিশ্চয়ই কোন একদিন বাঙালী ফিরে পাবে তার নিজের দেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে স্বাধীন করা দেশ। এ যখন ভাবছি তখন সাংবাদিক মনটাও কাজ করছে, সে খোঁজ নিচ্ছে, কোথা থেকে এই ছেলেটি এসেছে। ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে রাত জেগে জার্নি করে এই শাহবাগে এসেছে। জানা গেল ও বরিশাল থেকে লঞ্চে এসেছে। ওর বরিশাল থেকে আসার কথা শুনে মনে পড়ে গেল, নিজেরই তরুণ বেলা। বরিশাল নয়, পঁচাত্তরের পরের সেই দুর্দিনে একদিন গিয়েছিলাম পিরোজপুরে। কোন কাজে নয়, সেই দুঃসময়েও এক তরুণ মনের খেয়ালে কাউকে কিছু না বলে কাঠবডির বাসে চড়ে হাজির হই পিরোজপুরে। তারপরে অনেকের কাছেই শুনতে চাই, কোথা থেকে জীপের পিছনে বেঁধে ভগীরথীকে কোন্ রাস্তা দিয়ে কোন্ অবধি টেনে নিয়ে গিয়েছিল। না, সে দুর্দিনে মুখ খুলতে চায়নি কেউই। ওদিকে বিকেল গড়িয়ে যায়, ফিরে আসতে হবে। এ সময়ে খেয়া মাঝিকে একাকী পেয়ে জিজ্ঞেস করতে তিনি দেখিয়ে দেন সে রাস্তা। মাথা নিচু করে ওই রাস্তা ধরে হেঁটে যাই। তারপরে বুকের কাছে দু’হাত নিয়ে মনে মনে ভগীরথীর উদ্দেশে প্রণাম করি। পঁচাত্তরের পরে, আমার মতো একজন অতি সাধারণ ছাত্রের এর থেকে বেশি কিছু করার ছিল না। এই ভগীরথীর কথা আমি শুনি, যেদিন পিরোজপুর যাই তার দিন সাতেক আগে, পিরোজপুরের এক আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিকের কাছ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভগীরথীকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে ধরে নিয়ে যায় দেইল্লা রাজাকার। ভগীরথী পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে উৎসর্গ করেন স্বাধীনতার বেদিমূলে। তিনি অভিনয় করেন পাকিস্তানীদের সঙ্গে, মেনে নেন তাদের সব কথা। তারপরে গড়ে তোলেন তাদের ওখানে নিয়মিত যাতায়াত। আর খুঁজতে থাকেন কবে এই এলাকায় আসবে মুক্তিযোদ্ধারা। অবশেষে তিনি ঠিকই পেয়ে যান মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ। গোপনে গিয়ে দেখা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। তাদের খুলে বলেন সব কিছু। এরপরে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মতো খোঁজ খবর সব এনে দেন তিনি। সফল অভিযান করে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে। ভগীরথী মোট ক’টা অভিযানে সাহায্য করেছিলেন তার হিসাব জানতে পারিনি। দেইল্লা রাজাকারের মাধ্যমে এ খবর জেনে যায় পাকিস্তানীরা। তখন তাকে দড়ি দিয়ে মিলিটারি জীপের সঙ্গে বেঁধে পিরোজপুরের পাকা রাস্তা দিয়ে দুরন্ত গতির জীপের সঙ্গে টেনে নিয়ে যায় ভগীরথীকে। আঘাতে আঘাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয় ভগীরথীর দেহ। ভগীরথীর দেহ কত খ- হয়েছিল, কত স্থান বাঙালীর তীর্থ ক্ষেত্র হয়েছে তার হিসাবও রাখা হয়নি। হিসাব রাখা হবে কীভাবে? ১৯৭২ থেকে ৭৫-এর আগস্ট। তারপর থেকে তো রাজকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যদের দখলেই দেশ। এখনও বিভিন্ন বড় বড় অবস্থানে থেকে তারাই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এখনও শান্তি কমিটির সদস্য জাতিকে দাওয়াই দিচ্ছে, যারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়, তাদের পলিটিক্যাল এজেন্ডা আছে। পলিটিক্যাল এজেন্ডা আছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির। এজেন্ডা ঠিকই আছে, সে এজেন্ডা কি তা ভগীরথী দেখিয়ে গেছে। জীবন দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে জাতিকে ঘাতক দালালের হাত থেকে বাঁচানোই বাঙালীর এজেন্ডা। এ পথেই কেবল বাঙালী বাঁচবে। আর দেশ যে বাঁচবে তার প্রমাণ কিন্তু শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে আসা বরিশালের সেই তরুণটি। যার কণ্ঠ কাঁপিয়ে তুলেছিল গোটা শাহবাগ এলাকা, “আমার মা বীরাঙ্গনা, আমি আপোস জানি না।” এই কণ্ঠ একদিন ঠিকই কাঁপিয়ে তুলবে গোটা বাংলাদেশ। শাহবাগের প্রজন্মকে নানানভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। তবে তারপরেও তারা শেষ হয়ে যায়নি। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারাদেশে। তাদের আলোর মশাল যে কোন স্থান থেকে যে কোন মুহূর্তেই জ্বলে উঠবে। তারা ঠিকই বলবে, বাংলাদেশে একটি এজেন্ডা, সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এজেন্ডা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যখন শেখ হাসিনার উদ্যোগে জাহানার ইমামকে নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে তোলা হয়, তখন থেকেই এর বিরুদ্ধে রাজাকার মাওলানা মান্নান, শান্তি কমিটির প্রধান গোলাম আযমসহ দেশ বিরোধীরা। আসলে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বা কারাগারের রোজনামচা পড়লে যেমন জানা যায়, তেমনি আমরা যারা কয়েক শ’ বছরের ইতিহাস পড়েছি, সবাই আমরা এ সত্য বলতে পারি- বাঙালী এমন একটি জাতি – এ জাতিতে যেমন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ বোস, নজরুল, বঙ্গবন্ধু জন্মান; তেমনি এ জাতিতে গোলাম আযম, মোনায়েম খাঁ, মোশতাকদের মতো ইতরের অভাবও হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দাবিতে যারা আছেন তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাবাহী লোক বলার মতো ইতরের অভাবও এদেশে কখনও হয়নি। তবে গোলাম আযম, মোনায়েম খাঁ প্রমুখ অনেক ইতর শাস্তি পেয়ে গেছে। গোলাম আযম শুধু যে জেল খেটে মারা গেছে তা নয়, বায়তুল মোকাররম মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে মুসল্লিরা তাকে জুতো পেটা করেছিল। তাই আজ যেসব ইতর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিকে পলিটিক্যাল এজেন্ডা বলছে, তাদের কেবল স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়, ওই যে ছেলে শাহবাগে সেøাগান দিয়েছিল, যে ভগীরথীকে মা বলে সম্বোধন করেছিল - তার কোন শক্তি না থাকুক, পায়ে এক পাটি জুতো আছে। তার পূর্বসূরীরা ওই জুতাই ব্যবহার করে গেছে শান্তি কমিটির প্রধান গোলাম আযমের প্রতি। [email protected]
×