ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস গড়ে বিদায় মিসবাহ-ইউনুসের

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৭ মে ২০১৭

ইতিহাস গড়ে বিদায় মিসবাহ-ইউনুসের

ডমিনিকায় স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ টেস্টের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাবেক হয়ে গেলেন মিসবাহ-উল হক ও ইউনুস খান। জীবনের শেষ ইনিংসে অধিনায়ক মিসবাহ আউট হন ব্যক্তিগত ২ রানে, আর আধুনিক টেস্টের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান ইউনুস ফেরেন ৩৫ রান করে। এর মধ্য দিয়ে একসঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেটের দুটি গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। দুইজনে মিলে ১৯৩টি টেস্ট খেলে উপহার দিয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি রান, ওয়ানডে যোগ করলে সেটি পাহাড়সম। ১৬-১৭ বছরের ক্যারিয়ারের শেষ ৮ বছর জন্মস্থান পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে না পারার আফসোস মিটে গেল দারুণ সাফল্যে, রুদ্ধশাস নাটকীয়তার পর ১০১ রানের জয়ে। সেই ১৯৫৭ থেকে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্যারিবীয় দ্বীপে সিরিজ জিতল (২-১) পাকিস্তান। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরামরা যা পারেননি ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে, শেষ সিরিজে সেটিই করে দেখালেন মিসবাহ-উল হক। ইতিহাস গড়েই বিদায় নিলেন বড় দুই তারকা। গত বছর প্রথমবারের মতো দেশকে আইসিসি টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে তুলেছিলেন মিসবাহ, বিদায়ী সিরিজেই প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে ১০ হাজার রানের মাইলস্টোনে পা রেখেছেন ইউনুস। টেস্ট ও ওয়ানডে দিয়ে ইউনুসের (বর্তমানে ৩৯ বছর) আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু ২০০০ সালে। প্রায় চার বছরের বড় মিসবাহর (৪৩) শুরুটা তার পরের বছর, টেস্ট দিয়ে। পাকিস্তানে তখন তারকার অভাব নেই। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, মুশতাক আহমেদ, সাঈদ আনোয়ার, রশিদ লতিফ। ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন অধিনায়ক সালমান বাট ও দুই পেসার মোহাম্মদ আমির ও মোহাম্মদ আসিফ। কেঁপে ওঠে দেশটির ক্রিকেটের ভীত। পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য বিদেশী দলগুলো পাকিস্তানে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অনেকেই ভেবেছিলেন পাক-ক্রিকেট আসলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। কঠিন সেই পরিস্থিতিতে হাল ধরেন মিসবাহ। ব্যাট হাতে তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে যান ইউনুস। আর ওয়াসিম-ওয়াকারদের তারকা ইমেজের দূত হয়ে ছিলেন শোয়েব আকতার-শহীদ আফ্রিদিরা। তবে মাঠ ও মাঠের বাইরে, ক্রিকেটার ও ব্যক্তি চরিত্রের বিচারে তাদের কেউই মিসবাহ-ইউনুস হয়ে উঠতে পারেননি। ডমিনিকার উইন্ডসর পার্কে শনিবার টেস্টের চতুর্থ দিনে দ্বিতীয় ইনিংসে দুইজন যখন শেষবারের মতো ব্যাটিংয়ে নামেন পুরো ড্রেসিং রুম তখন দাঁড়িয়ে। ব্যাট উঁচিয়ে গার্ড অব অনার দিয়েছেন প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ খেলোয়াড়রা। ২ ও ৩৫ রানে আউটÑব্যক্তিগতভাবে শেষটা রাঙাতে পারেননি। কিন্তু দীর্ঘ ক্যারিয়ারের মতো এই সিরিজেও প্রমাণ করেছেন, পাকিস্তান ক্রিকেটে এখনও তারা কতটা অপরিহার্য। ছয় ইনিংসে মিসবাহর রান ৯৯*, ১২*, ৯৯, ০, ৫৯ ও ২। ইউনুস ৫৮, ৬, ০, ৫, ১৮ ও ৩৫। গ্রেট জাভেদ মিয়াদাদকে টপকে আগেই দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের মালিক হয়েছিলেন। জ্যামাইকায় প্রথম টেস্টে প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে ১০ হাজার রানের অনন্য মাইলফলকে পা রাখেন ইউনুস। ১১৮ টেস্টে ৫২.০৫ গড়ে নামের পাশে ১০০৯৯ রান, সেঞ্চুরি ৩৪টিÑ সকল ক্ষেত্রেই যা পাকিস্তানের হয়ে রেকর্ড। সম্প্রতি স্থানীয় এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের এক জরিপে টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে জনপ্রিয়তায় জহির খান, জাভেদ মিয়াদাদ, ইনজামাম-উল হকের চেয়ে এগিয়ে মোহাম্মদ ইউনুস খান। সেই তুলনায় বেশি বয়সে অভিষেক হওয়া মিসবাহ খেলেছেন ৭৫ টেস্ট, ইউনুসের চেয়ে অনেক কম। তারকায় ঠাসা দলে শুরুতে ছিলেন ৬-৭ নম্বর ব্যাটসম্যান। সেভাবে ধারাবাহিকও হতে পারেনি। তবে ২০১০Ñএ পাকিস্তান ক্রিকেটে বাটদের সেই ফিক্সিং কলঙ্কের পরের অধ্যায়টি ধরলে সেখানে কেবল মিসবহার নামটিই জ্বলজ্বল করবে। ব্যাটিংয়ে নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন দলের নিউক্লিয়াস। ২০০৯ সাল থেকে নিজেদের মাটিতে খেলার সুযোগ হয়নি। এরপরও প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে তুলেছেন। ১০ সেঞ্চুরিতে ৪৬.৬২ গড়ে করেছেন ৫২২২ রান। বিদায় বেলায় মিসবাহ আরও বলেন, ‘নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আমি তৃপ্ত। আর কী শেষটাই না হলো! এর চেয়ে ভালভাবে শেষ হতে পারত না। দল, সতীর্থ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই তারা যেভাবে আমাকে ও ইউনুসকে বিদায় জানাল। ইউনুসকেও স্পেশাল ধন্যবাদ, ওর পরবর্তী জীবনের জন্য শুভকামনা থাকল। ওর সঙ্গে এ ছিল আমার দারুণ দীর্ঘ এক যাত্রা। একসঙ্গে যার সমাপ্তিটা হলো দারুণভাবে।’ সতীর্থ ইউনুসকে নিয়ে মিসবাহ বলেন, ‘আমি যখন পাকিস্তানের অধিনায়ক হইনি, তখনও আমরা দুইজন একসঙ্গে অনেক ক্রিকেটে খেলেছি। সেটি ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। দেখেছি কিভাবে সে দলের সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছে। ব্যাটসম্যান ইউনুসের পাশাপাশি মানুষ ইউনুসকেও আমি গ্রেটদের কাতারে রাখব।’ অধিনায়ক হিসেবে ইউনুসকে কাছ থেকে দেখেছেন সাবেক তারকা ইনজামাম-উল হক। বর্তমানে যিনি পাকিস্তান দলের প্রধান নির্বাচক। সেই গ্রেটের মূল্যায়ন, ‘ইউনুস যখন দলে এল আমি ওর মধ্যে কেবল প্রতিভাই দেখিনি বরং একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যাটসম্যানকেও দেখেছিলাম। ওর বড় গুণ দলের প্রয়োজনে ঠিকই বড় ইনিংস খেলে দেয়।’ মিসবাহ-ইউনুসকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে এক ভিডিও বার্তায় সাবেক অধিনায়ক রমিজ রাজা বলেন ‘ওরা দুইজনই পাকিস্তান ক্রিকেটে অনেক অবদান রেখেছে। দেশের ক্রিকেটনুরাগী মানুষ তাদের মিস করবে। এই শূন্যতা কখনই পূরণ হওয়ার নয়! ব্যক্তিগতভাবে মিসবাহ-ইউনুসের উপস্থিতি মিস করব আমি। পাকিস্তান তাদের অবদান সবসময়ই স্মরণ রাখবে।’ ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভনের টুইট বার্তা, ‘ইউনুস খান এবং অধিনায়ক মিসবাহকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তারা অসাধারণ দুইজন ক্রিকেটার; ভাল মানুষও।’ শত্রুদেশ ভারতের সাবেক ক্রিকেটার আকাশ চোপড়া লিখেছেন, ‘পাকিস্তান ক্রিকেটে মিসবাহ-ইউনুস অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। মাঠে ও বাইরে ওরা ছিল অসাধারণ চরিত্র। তাদের অভাব পূরণ করা দেশটির জন্য সত্যি কঠিনই হবে। দ্বিতীয় ইনিংসের জন্য (অবসর জীবন) দুইজনের প্রতিই আমার শুভকামনা থাকল।’
×