ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশে সাড়ে ৮ লাখ নারী দিনমজুর, অধিকাংশই শহুরে নির্মাণ শ্রমিক

‘এক লগে কাজ করে ব্যাটা মানুষ মজুরি পায় আমাগো চেয়ে বেশি’

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১ মে ২০১৭

‘এক লগে কাজ করে ব্যাটা মানুষ মজুরি পায়  আমাগো চেয়ে বেশি’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ স্বাধীনতার ৪৭ বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অবদান রেখে যাচ্ছে। নারীরা আজ শ্রম অঙ্গনের কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তা-চেতনাকে পাশকাটিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীরা নিজেদের স্থান প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। বিবিএস’র (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) তথ্য অনুযায়ী বর্তমান জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি প্রায় নারী। তার মধ্যে শতকরা ৮.২ ভাগ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মরত। দেশের বিকাশমান অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পেছনে নারী শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকলেও কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা শ্রমবিভাজন ও মজুরি বৈষম্যসহ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্য মেনে নিয়েই পুরুষের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। পুরুষ শ্রমিকের সমান বা কখনও কখনও বেশি কাজ করেও কম মজুরি পাচ্ছেন তারা। সেসঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব। ঘরের কাজ সেরে জীবিকার জন্য মাঠে নেমেও সমান মর্যাদা পাচ্ছেন না নারী শ্রমিকরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা ঘরে-বাইরে নিগৃহীত হচ্ছেন। শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। মিরপুরে একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছেন কয়েক নারী। কেউ বালি, কেউ ইট ঝুড়িতে করে বহন করছেন। তাদের একজন আয়েশা খাতুন। প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধ নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের কাজ ও রান্না সেরে বের হই। এরপর কালশী মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা করি কাজের জন্য। অনেক সময় ঠিকাদাররা নারী বলে কাজে নিতে চান না। কিন্তু একদিন কাজ না করলে তো সংসার চলবে না। ক্লান্তিহীনভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ঘরে ফিরেও আবার সংসার সামলাতে হয় তাদেরই। নারী-পুরুষ একই কাজ করলেও নারীদের বেলায় মজুরি কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের মজুরির অর্ধেক পাই। কাউকে কিছু বলার নেই। প্রতিবাদ কার কাছে করব, তখন তো কেউ কাজই দেবে না। আয়েশার সঙ্গেই কাজ করছেন মধ্যবয়স্কা ফাতেমা বিবি। গ্রীষ্মের খরতাপে প্রায় অতিষ্ঠ সে। কাক ডাকা ভোরে কাজের উদ্দেশে বেরিয়েছেন তিনি। তখন প্রায় দুপুর, কথা বলার সময় নেই তার। জানালেন, ‘ঠিকাদার কাজ ছেড়ে কথা বলতে দেখলে বকবেন। তারপর বললেন, ‘আমাগো কথা আর কে বা হুনব? ঠিক মতো ট্যাকা পাই না। আর মজুরিও অনেক কম। এক লগে কাজ করে ব্যাটা মানুষ পায় বেশি আর আমরা পাই কম। একই রহম কর্ম করি আমরা, কিন্তু তাগো চেয়ে ট্যাকা কম পাই। সরকার যদি সব মালিকগো কয়ে দিত তাহলে আমরা সমান মজুরি পাইতাম।’ নারী শ্রমিকরা জানান, কর্মক্ষেত্রে মজুরির বৈষম্য জেনেও জীবিকার তাগিদে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে সমানতালে কাজ করলেও কখনও কখনও পুরুষ সহকর্মী কিংবা ঠিকাদারের হাতে নিগৃহীত হতে হয় তাদের। এমনকি অনেক সময় নারী বলে কাজে নিতেও আপত্তি জানান ঠিকাদাররা। কাজের ধরন ও সময় অনুসারে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও নারীরা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক কিংবা তার চেয়েও কম মজুরি পান। পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৪০০-৬০০ টাকা মজুরি পেলেও নারী শ্রমিককে দেয়া হয় ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা। শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, অনেক ক্ষেত্রে ঘরেও নিগৃহীত হন তারা। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আট লাখ ৪৯ হাজার নারী দিনমজুর রয়েছেন। এদের মধ্যে শহরে মূলত নির্মাণশ্রমিকই বেশি। গার্মেন্টস শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে যে কোন স্তরে নারীর শ্রমের অবমূল্যায়ন চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১৩ সালে প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন। বিবিএস পরিচালিত ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬২ লাখ। আর ২০০৬ সালে ওই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪৯ লাখ নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কর্মক্ষেত্রে ক্রমশ নারীর উপস্থিতি বেড়ে চলেছে। নারী শ্রমিকের একটা বিরাট অংশ কাজ করে গার্মেন্টস শিল্পে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে মজুরি বৈষম্যসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির অভাব। সরকারী উদ্যোগে যদি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও নারীদের জন্য মজুরির সমতা নির্ধারণ করা হয় তাহলে শ্রমজীবীদের মজুরি বৈষম্য দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে করেন সালমা আলী। তিনি বলেন, ‘অতীতের চেয়ে শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বেড়েছে। তবে বৈষম্য দূর হয়নি। শ্রমজীবী মানুষ বরাবরই নিপীড়িত। এরমধ্যে নারীরা বেশি বৈষম্যের শিকার। শ্রমজীবী মানুষের নেই সামাজিক মর্যাদা, বিশ্রাম, নিরাপত্তার কর্মস্থল, পেশাগত নিরাপত্তা। বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবীদের বছর বছর বেতন-ভাতা বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের আসলে সংগঠিত হয়ে দাবি আদায়ে আন্দোলনের সুযোগ নেই। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও নারী শ্রমিকদের জন্য মজুরির সমতা নির্ধারণ করে দিলে বৈষম্য দূর হবে। নিশ্চিত হবে নারীর কাজের মর্যাদাও।’ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম নারী শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ যুগ যুগ ধরে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় কর্মক্ষেত্রেও নারীরা পদে পদে বৈষম্যের শিকার আজও হয়ে আসছে। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে কিন্তু নিম্ন মজুরি প্রদান, অস্থিতিশীল আয়, অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, নারী শ্রমিকদের প্রতি মজুরি বৈষম্য, ছুটি ও প্রচলিত বিধান না থাকার কারণে প্রতিনিয়ত তাদের শ্রম শোষণের শিকার হতে হয়। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় এ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনতে হবে। মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ইতিমধ্যেই নারী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সার্বিক ক্ষমতায়তনের লক্ষ্যে নারী-বান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে ৩১ দাবির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই দাবিসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও পোশাকশিল্প মালিকদের কাছে জোড়ালো আহ্বান জানানো হয়েছে।’ বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে। এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও সুখবর হলো, পুরুষদের মধ্যে যেখানে বেকারত্বের হার বাড়ছে, সেখানে নারীদের বেকারত্বের হার কমেছে। ২০০৬ সালে যেখানে নারী বেকারের হার ছিল ৭ শতাংশ, ২০১০ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। আর পুরুষের ক্ষেত্রে দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া যুবশক্তিতে তরুণীদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৪৬ লাখ তরুণী শ্রমবাজারে ছিলেন। আর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখে। আলোচ্য সময়ে তরুণীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের হার প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে তরুণ-তরুণী মিলিয়ে মোট যুবশক্তিতে রয়েছেন দুই কোটি নয় লাখ। সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরাই তরুণ প্রজন্ম। নারীর ক্ষমতায় বাড়ছে কিন্তু এখনও শ্রম ও মজুরি বৈষম্য নারীর অর্থনৈতিক অবদানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ১২৭ বছর আগে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর থেকে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের দিন হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে বহু শ্রমিক হতাহত হন। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দিবসটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আর কত মে দিবস পালিত হলে এসব অসহায় নারী শ্রমিকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন হবে।
×