ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কিশোরীদের সচেতন করার উদ্যোগ

সাইবার অপরাধ বেড়েই চলেছে, নারীরাই প্রধান শিকার

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৯ এপ্রিল ২০১৭

সাইবার অপরাধ বেড়েই চলেছে, নারীরাই প্রধান শিকার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এই সেবা পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এখনও অনেকের অজানা। এজন্য দিনকে দিন বেড়েই চলছে সাইবার অপরাধ। আর এ অপরাধের শিকার হচ্ছে দেশের নারীরা। সম্প্রতি ২৯ জানুয়ারি ফেসবুক প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মিরপুরে ধর্ষণের শিকার হয় এক স্কুলছাত্রী। সে মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। ফেসবুকে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাদের দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফেসবুকে মেসেজ পাঠানো, একে অন্যের ছবি পাঠানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। কিছুদিন পর ছেলেটি দেখা করার প্রস্তাব পাঠায়। মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় এবং সে মিরপুর-১ এ ওই যুবকের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যায়। ছেলেটি তার এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এরপর সে ভয় পেয়ে মিরপুরের একটি হাসপাতালের বারান্দায় মেয়েটিকে রেখে পালিয়ে যায়। এরপর মেয়েটির পরিবার রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা চালায় মেয়েটির। শুধু এ ঘটনা নয়। সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে অতীতে অনেক কিশোরী আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়েছে। মূলত প্রতিহিংসা, ব্ল্যাকমেল, বিয়েতে রাজি না হওয়া, যুবকদের বিকৃত মানসিকতা ইত্যাদি কারণে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ থেকে প্রায় কেউই বাদ যাচ্ছে না। সাইবার ক্রাইম থেকে সেলিব্রিটিরাও বাদ পড়ছেন না। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাবিলা নূর সাইবার অপরাধের শিকার হন। বিদেশী ওয়েবসাইট থেকে একটি স্ক্যান্ডাল ভিডিও নিয়ে সেটাকে সাবিলা নূরের হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে অনলাইন দুষ্কৃতকারী। কিন্তু সাবিলার শুভাকাক্সক্ষী বন্ধু ও ভক্তরা এই অপচেষ্টাকে আটকে দেয়। শহরের চেয়ে গ্রামের মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার। অনেক? ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্র মা-বাবা বোঝেন না যে তাদের মেয়ের ছবি ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করা সম্ভব। ফলে তারা অন্যদেরও বোঝাতে পারেন না। আর এদিকে সেই অপরাধের শিকার মেয়েটি মা-বাবা এমনকি প্রতিবেশী কর্তৃক লাঞ্ছিত হতে থাকে। সাইবার অপরাধ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই একটি বড় অপরাধে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে সাইবার অপরাধ। অল্প বয়সী মেয়েরা যার প্রধান শিকার। অনেক সময় তারা বুঝতে পারে না কি করবে, কাকে জানাবে? অনেকে এমনকি আদৌ কাউকে জানায় না। নীরবে ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের যৌথ আলোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের শিকার মানুষের বড় অংশটি অল্পবয়সী নারী বা কিশোরী। সাইবার হয়রানি ও অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতন করতে বাংলাদেশের মোট ৪০টি স্কুলের প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ছাত্রীকে ‘সাইবার সিকিউরিটি এ্যাওয়ারনেস ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়লে বা সাইবার হয়রানির শিকার হলে কী করা উচিত বা কী পদক্ষেপ নিতে হবে, এ ব্যাপারে কিশোরীদের সচেতন করা এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য। ‘সাইবার সিকিউরিটি এ্যাওয়ারনেস ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ কর্মশালার উদ্বোধনী দিনে রাজধানীর আটটি স্কুল ও কলেজের একশ’ ছাত্রীকে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে ১৯ এপ্রিল থেকে এই প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হয়েছে। রাজধানীর ৪টি স্কুলের ৬ শতাধিক ছাত্রী উদ্বোধনী দিনে এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। দুদিনব্যাপী এ কর্মশালায় নয়টি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। চলতি মাস ও মে মাসের মধ্যে দুদিনব্যাপী এ কর্মশালায় দেশের বিভিন্ন স্কুলের ১০ হাজার স্কুলছাত্রীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানান আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আগামীতে এই প্রশিক্ষণ কর্মশালার ব্যাপ্তি ঘটবে বলেও জানান তিনি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ: সাইবার অপরাধ, নিরাপদ ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানান, সাইবার জগতে সবচেয়ে বেশি অপরাধের শিকার নারী। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর ৭৩ শতাংশই নানা ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। তার মতে, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে আমরা খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেছি। তবে নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একই গতিতে এগোতে পারিনি। এ খাতে আমাদের আরও কাজ করার জায়গা আছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর ৭৩ শতাংশ সাইবার অপরাধের শিকার হলেও এর ২৩ শতাংশই অভিযোগ করেন না। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শতকরা ৪৯ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী অনলাইনে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৮৪ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪৩ বছরের মধ্যে। সরকার এ শক্তিকে কাজে লাগাতে চায়। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে ‘সাইবার সিকিউরিটি এ্যাওয়ারনেস ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ কর্মশালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের যুগ্ম সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ শরাফুদ্দিন এ কর্মশালা সম্পর্কে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে আট বিভাগের মোট ৪০টি স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেয়াা হবে। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছাত্রীদের হাতেকলমে শেখানো হবে সাইবার আক্রমণের বা অপরাধের শিকার না হওয়ার কী কী উপায় ও সতর্কতা রয়েছে। সেই সঙ্গে অপরাধের শিকার হলে কী কী আইনী সুরক্ষা মেয়েটি পেতে পারে, কোথায় অভিযোগ করতে হবে, কার কাছে প্রতিকার চাইতে হবে, সেটাও জানতে পারবে। সাইবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ইতোমধ্যেই একটি ‘হেল্প ডেস্ক’ প্রকাশ করেছেন। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ এবং দমনে চালু হেল্পলাইন (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) সপ্তাহের সাত দিন, ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ হেল্পলাইনে সরাসরি ফোন করে অথবা এসএমএসের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারবেন। জানা গেছে, সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে গঠিত এই সাইবার হেল্প ডেস্কে অভিযোগকারীর ৭০ ভাগই নারী। নারীদের অভিযোগের ৬০ ভাগেরও বেশি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক নিয়ে। তবে ১০ ভাগ বিপজ্জনক। এই ১০ ভাগের মধ্যে রয়েছে অন্যের ছবিতে ছবি জুড়ে দেয়া এবং পর্নোগ্রাফি। এছাড়া সাইবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে সরকার হটলাইন ‘৯৯৯’ চালু করেছে। যে কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে এই হটলাইনে ফোন করেও অভিযোগ জানাতে পারে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপরাধের মোকাবেলা করতে ২০১৩ সালে বিশেষ আদালত গঠন করে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি মামলা নিয়ে ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়। কিন্তু পরের বছর মামলা আসে ৩২টি। ২০১৫ সালে ১৫২টি ও ২০১৬ সালে ২৩৩টি মামলা। আর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই এসেছে ১৪১টি মামলা। ঐ আদালতে এ পর্যন্ত ৪৫০ টি মামলার শুনানি হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে এখন ৩৮২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং এলিট ফোর্স র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাইবার অপরাধ তদন্ত বিষয়ক সেল রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিদিন আমাদের কাছে ১০ থেকে ১২ টা সাইবার হয়রানির অভিযোগ আসে। এদের মধ্যে ৯০ ভাগ অভিযোগ অল্পবয়সী ও কিশোরীদের। পুলিশ বলছে, এসব কিশোরীর খোলামেলা পোশাকে ছবি পাঠাতে বলা হয় বা তারা যখন খোলামেলা পোশাকে থাকে তখন সরাসরি ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করা হয়। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ভিডিও ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করা হয়। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ভিডিও বা ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয় বা ট্রল বানানো হয়। সাইবার অপরাধ দমনে স্ব স্ব সচেতনতা জরুরী।
×