ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৯ এপ্রিল ২০১৭

জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার নেপথ্যে-

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই গাইবান্ধায় জেএমবি সদস্য ফজলে রাব্বীকে দলীয় নির্দেশে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা ও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁয় হামলার অন্যতম আসামি রাজীব গান্ধী। শুধু ফজলে রাব্বী নয়, ২০১০ সালে উত্তরায় প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে জেএমবি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় রাশেদকে হত্যা করে জেএমবি সদস্যরা। জঙ্গী সংগঠন থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যদের দলীয় নির্দেশে দলের জঙ্গীরাই হত্যা করে থাকে। এটি জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার অন্যতম কারণের মধ্যে একটি। সম্প্রতি জঙ্গীদের বেশি হারে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা খুবই উদ্বেগের বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। গত ১৩ জানুয়ারি রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে (৩২) গ্রেফতার করে। সে সুভাষ, শান্ত, টাইগার, আদিল ও জাহিদ নামেও পরিচিত। ঢাকা ছাড়াও যেসব জেলায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, সেসব মামলায় দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গত ২৭ মার্চ গাইবান্ধার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মোঃ জয়নাল আবেদীনের আদালতে রাজীব গান্ধী জেএমবি সদস্য ফজলে রাব্বী হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকা-ের আদ্যোপান্ত বর্ণনা ছাড়াও রাজীব গান্ধীর সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পায় তাতে। রাজীব গান্ধীর বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের মালঞ্চা গ্রামে। পার্শ্ববর্তী সাঘাটা উপজেলার রাঘবপুর ভূতমারা (চকদাতেয়ার) গ্রামে তার পুরনো বাড়ি ছিল। পিতা ওসমান মুন্সী কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। রাজীব গান্ধী গ্রেফতার হওয়ার প্রায় তিন বছর আগে তার পিতার মৃত্যু হয়। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে সে। এরপর পিতার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করত। গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত থাকত না। গ্রেফতার হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে অর্থাৎ পিতার মৃত্যুর পর পরই সে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। পরিবারের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। ২০০৪-০৫ সালে খুব অল্প বয়সে সে জঙ্গীবাদে জড়ায়। সে শীর্ষ জঙ্গী নেতা শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা ও জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শূরা সদস্য আবদুল আউয়ালের পাচক ছিল। আবদুল আউয়ালের বিভিন্ন চিঠিপত্র সাইকেলে করে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিত। জঙ্গীদের সঙ্গে থাকতে থাকতেই সে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। তামিম চৌধুরীর মাধ্যমে পুরনো জেএমবি ছেড়ে যোগ দেয় নব্য জেএমবিতে। উত্তরবঙ্গের সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। সূত্র বলছে, ২০০৭ সালে এলাকা থেকে পালিয়ে যায় জেএমবি ক্যাডার ফজলে রাব্বি। জেএমবির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। চাকরি নেয় গার্মেন্টসে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে আত্মগোপন ছিল। বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বসন্তেরপাড়া গ্রামে। পিতার নাম সাদাক্কাস আলী। ২০১৫ সালের জুলাইতে ঈদ উপলক্ষে রাব্বী গোপনে বাড়িতে যায়। ওই বছরের ১৯ জুলাই রাতে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি ওয়াপদা বাঁধের উপর ফজলে রাব্বীকে (৩০) মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। দুইটি মোটরসাইকেলযোগে চারজন এসে রাব্বীকে হত্যা করে। রাব্বীর সঙ্গে থাকা জেএমবি ক্যাডার এনামুলাহ মিয়াকে মারধর করে ছেড়ে দেয় হত্যাকারী জেএমবি সদস্যরা। পুলিশ এনামুলাহ মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠায়। পুলিশ বলছে, ফজলে রাব্বী কারাগারে ছিল। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর সে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। ঢাকার কেরানীগঞ্জে আত্মগোপনে থাকাকালে সে গার্মেন্টসে চাকরি করত। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফজলে রাব্বী চাকরির সময় জেএমবি বা অন্যকোন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। জেএমবির কর্মকা-ও চালাত না। এমনকি জেএমবি সংক্রান্ত কোন তথ্যও যে এলাকায় আত্মগোপনে ছিল সে এলাকায় এবং যে গার্মেন্টসে চাকরি করত সেখানকার কারও কাছেই প্রকাশ করত না। একেবারেই নীরবে আত্মগোপনে ছিল। রাজীব গান্ধীর জবানবন্দীর বরাত দিয়ে দায়িত্বশীল এক উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জেএমবি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে চার জেএমবি সদস্য ফজলে রাব্বীকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে নিশ্চিতভাবে হত্যা করে। যা রাজীব গান্ধী তার জবানবন্দীতে স্বীকার করেছে। ফজলে রাব্বী জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরেই দল রাব্বীকে হত্যা করতে নির্দেশ দেয়। দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যরা দলের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে, দলের হয়ে কাজ না করলেই দলের অলিখিত নিয়মানুযায়ী তাদের হত্যা করা হয়। দলের সদস্যরাই হত্যাকা-ের দায়িত্ব পালন করে। দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যদের কাছ থেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই দলচ্যুতদের হত্যা করা হয়। তবে দলচ্যুতদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মনিটরিং করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দলচ্যুত সদস্য দলে না ফিরলে তাকে হত্যা করা হয়। বিশ্বাসঘাতক হিসেবে খুবই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় দলচ্যুতদের। জঙ্গী নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা জানান, এমনই একটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল ২০১০ সালে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে শত শত মানুষের সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেঁটে রাশেদ নামে এক যুবককে হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পিলে চমকানোর মতো তথ্য দেয়। তারা জানায়, নিহত রাশেদ জেএমবি সদস্য ছিল। নিহতের বছর খানেক আগে সে জেএমবি থেকে বেরিয়ে যায়। দলের কর্মকা- তার ভাল লাগেনি। দল থেকে বেরিয়ে সে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস শুরু করে। সে পুরোপুরি আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপন করার পর রাশেদকে হত্যা করতে দলীয় নির্দেশ আসে। যদিও এটি অলিখিত নিয়ম। সেই হত্যাকা-ের কাজটি করার জন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোতে এক বা একাধিক গ্রুপ রয়েছে। এসব হত্যাকারী গ্রুপ বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয়ার পাশাপাশি দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যদেরও হত্যা করে থাকে। রাশেদের সন্ধান জানতে জেএমবি সদস্যরা চেষ্টা করতে থাকে। এক পর্যায়ে রাশেদের সন্ধান মিলে। রাশেদ দক্ষিণখান থানা এলাকার একটি মসজিদে ইমামতির চাকরি নিয়েছিল। শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার আগে জঙ্গীবিরোধী বয়ান দিত। এক পর্যায়ে জেএমবির সার্বিক কর্মকা- সম্পর্কেও অনেক গোপন তথ্য সে বয়ানে প্রকাশ করছিল। যাতে সাধারণ মানুষ জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হন। এরপর রাশেদকে জেএমবি সদস্যরা হত্যা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। রাতেও তার বাসায় গিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হত্যা করতে পারেনি। এরপর দিন দুপুরেই রাশেদকে কুপিয়ে হত্যা করে। তবে জঙ্গী সংগঠনে নাম লেখানোর সময় প্রবেশকারীদের এ বিষয়টি সম্পর্কে কোন কিছুই জানানো হয় না। এটি জঙ্গী সংগঠনগুলোর কৌশল। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গী সংগঠনগুলো থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যদের হত্যার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। বেরিয়ে যাওয়া সদস্যদের সংগঠনের নির্দেশে এবং সিদ্ধান্তেই হত্যা করা হয়। দলের অন্য সদস্যরাই তাদের হত্যা করে থাকে। এটি জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে একটি। তবে অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত কারণে জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পেশাদার দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের মধ্যেও এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গী সংগঠন থেকে বেরিয়ে যাওয়া জঙ্গীদের জঙ্গীদের হাতেই খুন হওয়ার ঘটনা, জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে একটি।
×