ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমার পৃথিবী ছোট করে চলে গেলেন সাযযাদ কাদির ভাই -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

আমার পৃথিবী ছোট করে চলে গেলেন সাযযাদ কাদির ভাই -স্বদেশ রায়

মারা যাওয়ার মাত্র দিন সাতেক আগে রাত ৯টার দিকে তার ফোন। এ সময়ে তিনি বেশি ফোন করতেন। জানতেন, এতক্ষণে আমার নিউজ দেখা শেষ হয়েছে। ফোন ধরতেই কোন কুশল বিনিময় না করেই বললেন, কোন্ সময় এলে আপনাকে ফ্রি পাব বলেন তো। বললাম, সাযযাদ ভাই আমার অবস্থা তো গেছো বাবার মতো। তাই আপনি কখন আসতে চান। বললেন, “না আপনার ওপর আমার হামলা করতে হবে। কম্পিউটার থেকে কবিতাগুলো নিয়ে যেতে হবে। কারণ, আমি বুঝতে পেরেছি, আমি কবিতাগুলো সাজিয়ে না দিলে আপনার আর কোন দিন কবিতার বই বের করা হবে না।” এ কথা ওই দিন প্রথম নয়, গত কয়েক বছর ধরেই সাযযাদ ভাই বলছেন। একদিন বেশ রাতেই ফোন করেন। কিছুটা আতঙ্কিত হই। এত রাতে সাযযাদ ভাইয়ের ফোন কেন? ফোন করে, সেদিনও সরাসরি ওই কবিতার কথা। বললেন, আপনার কবিতা মোট কতগুলো হয়েছে বলুন তো? বললাম সাযযাদ ভাই, কবিতা একটাও হয়নি। তবে ছোট ছোট লাইনে যা লিখি তার সংখ্যা পাঁচ-সাত শ’ তো ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৪ এর দিকে একটা ফোল্ডারে ক্রমিক নম্বর দিয়ে ১০১টি লিখেছিলাম। তাতে মনে হয় গোটা পাঁচেক অসম্পূর্ণ। সাযযাদ ভাই বলেন, আপনার ভয়টা ভেঙ্গে দেয়া দরকার। সেটা আমি দেব। যেমন করে কবিতা পত্রিকায় প্রকাশের ভয় ভেঙ্গেছি অমন করেই ভাঙব। এই ছিল কবি সাযযাদ কাদিরের হৃদয়। আর লেখা! সাযযাদ কাদিরের লেখার মূল্যায়ন হয়নি। কেন হলো না সে বিষয়ে যাব না। এ সত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পাঠক এবং লেখক দুই নিয়েই আলোচনা করতে হয়। ও পথ না মাড়ানোই ভাল। তবে উপন্যাসিক সাযযাদ কাদির আসলে উপন্যাসের নামে কখনও কখনও মহাকাব্য লেখাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করেননি। একবার জনকণ্ঠে একটা ঈদ সংখ্যার জন্য তার কাছে ভিন্ন স্বাদের একটা উপন্যাস চাই। বলি, সাযযাদ ভাই, আপনার মনমতো একটা উপন্যাস এবার লিখবেন কিন্তু। তিনি বললেন, যদি পাঠক না পড়ে। আমি বলি, দেখুন জনকণ্ঠের কিছু পাঠক আছে তারা জনকণ্ঠের সব ছাপার অক্ষরই পড়েন। প্রিন্টার্স লাইনও পড়েন। সাযযাদ ভাই বললেন, সাহস পেলাম। লিখে ফেলি একটা। এখনও তো তিন মাস সময় আছে। আমি বলি, না আপনার জন্যে সাড়ে তিন মাস। সাযযাদ ভাই বলেন, বেশ বড় হবে কিন্তু। হেসে বলি, কোন ক্ষতি নেই। আপনার জন্য প্রয়োজনে পাতা বাড়াব, পত্রিকার কলেবর বাড়বে। কিন্তু মনে মনে ভেবে ছিলাম ভিন্ন। সম্পাদনা করতে করতে নিজের ভেতরে যে একটি ঠগি চরিত্র দাঁড়িয়ে যায় এ কিন্তু তারই প্রকাশ। যা হোক, সময়মতো বা কয়েকদিন পার করে সাযযাদ ভাই উপন্যাসটি পাঠালেন। হাতে নিয়ে হিসাব করে দেখি পত্রিকার পাতার দশ থেকে বারো পাতা হবে। অর্থাৎ গল্পের আকৃতি। অবশ্য লেখা হাতে পাওয়ার আগে তার ফোন। “আপনি নিজে পড়বেন এবং নিজে প্রুফটা অন্তত একবার দেখে দেবেন।” সাযযাদ ভাইয়ের লেখাটা যখন হাতে পেয়েছিলাম তখন আমার অফিস টাইম শেষ। ভাবলাম, এক দুই পাতা চোখ বুলিয়ে কম্পোজে দিয়ে যাব। কিন্তু পড়া শুরু করে কখন যে শেষ হয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। প্রায় রাত বারোটা বেজে গেছে। পিয়ন লোকমান না হয় সাত্তার বেচারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি পড়া শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে জানালা পথে বাইরে তাকালাম অন্ধকার আর বিজলীবাতি এই দুই মিলে তখন একটা আলাদা রূপ দিয়েছে রাস্তাকে। কিন্তু রাস্তার রূপ আমাকে টানেনি। কারণ তখনও আমি কোন এক অতীত যুগে। যেখানে কয়েক নারী ভিন্ন হয়েছে, কিন্তু তার পরেও তারা নারী। ভাষা, কাহিনীর বুননী আর তার ভাব গাম্ভীর্য। সব মিলে সে এক আলাদা জগত। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিয়ে সাযযাদ ভাইকে ফোন করি, সাযযাদ ভাই এখানে মহাকাব্যর কত সর্গ লিখেছেন আপনি? তিনি হাসলেন। কোন উত্তর নেই। বুঝতে পারি তিনি ধরা পড়ে গেছেন। বলি, সাযযাদ ভাই, সাংবাদিকতা করে, সংসার চালিয়ে এ মহাকাব্য শেষ করা যায় না আমিও জানি। তার পরেও আপনাকে অনুরোধ করব, এর আর কয়েক সর্গ আমাকে আগামী ঈদ সংখ্যায় আপনি দেবেন। সাযযাদ ভাই হেসে বললেন, কেউ পড়বে কি? তাকে বলি, সাযযাদ ভাই না পড়লেও ক্ষতি নেই। এমন সৃষ্টি করে স্রষ্টা নিজেই যে আনন্দ পায় সেই আনন্দই কি পৃথিবীতে অনেক নয়! সাযযাদ ভাই এবার তার লাজুক খোলসের ভেতর নিজেকে নিয়ে নিলেন, বললেন, “আপনি আমার লেখা অনেক বেশি পছন্দ করেন।” আমি জানি এ নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা। সব লেখকই এভাবে নিজেকে ঢেকে রাখে। অলেখকরাই নিজেকে প্রচার করে। একবার এক বড় পপুলার লেখক তাঁর বাসায় এক আড্ডায় বলেছিলেন, একটা বই লেখা হয়ে গেলে ওই বই আর সাবানের ভেতর কোন পার্থক্য থাকে না। দুটোই কমুডিটি। তাই দুটোকেই ভাল মোড়কে ঢাকতে হয় যাতে বিক্রি হয় অনেক বেশি। ওই লেখকের বাসা থেকে বের হয়ে যখন কয়েকজনে মিলে গাড়িতে চাপি তখনও কিন্তু কথাটা মনে খুব আঘাত করেনি। পরে গুলিস্তান থেকে যখন লক্ষ্মীবাজার নিজের বাসার পথে হাঁটতে শুরু করি তখন অনেক রাত। গভীর রাতে পুরনো ঢাকার মহল্লা ধরে হাঁটার ভেতর ছিল আরেক সুখ। যাক, সে অন্য কথা। তখন হঠাৎ মনে হলো, লেখা আর সাবান এক! আবার কয়েক রশি পিছিয়ে ঠাঁটারী বাজারের গলি পার হয়ে নবাবপুর রোডের বল সাবানের দোকানগুলোর সামনে এলাম। দোকানগুলো তখন বন্ধ হয়ে গেছে। তার পরেও দাঁড়িয়ে থেকে বেশ সাবানের গন্ধ পাচ্ছিলাম। কিন্তু না একটা লেখা শেষ হয়ে গেলে চার পাশে যে সুবাস বের হয় সে সুবাসের সঙ্গে একদিনই শুধু মিল পেয়েছিলাম, স্বপ্নে মা পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারা ঘর সুবাসে ভরে গিয়েছিল। ঠিক একই গন্ধ। লেখা শেষ হলে চার পাশে যে গন্ধ নামে সেই গন্ধ। না, ওই বল সাবানের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ওই গভীর রাতে সে গন্ধ আমি পাইনি। আজ আর জীবনে এসব রাত নেই। লেখক হওয়ার স্বপ্ন কখন যে কীভাবে সাংবাদিকতার কানা গলিতে হারিয়ে গেছে তা ঠিক পায়নি। তবে সাযযাদ ভাইয়ের ওই উপন্যাসের নামে মহাকাব্যর উপক্রমণিকা পড়তে পড়তে শুধু সে সুবাস পেয়েছিলাম তা নয়, বুঝতে পারি সাংবাদিকতার কানা গলিতে কত বড় এক কলম আটকে পড়ে আছে। সাযযাদ কাদির ভাই নিরীক্ষার অনেক বড় ও সফল সম্পাদক। তার চাকরি শেষ হওয়ার পরে আর নিরীক্ষা পত্রিকার ভাল কোন সংখ্যা বের হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি। সাযযাদ কাদির ভাই এই নিরীক্ষা পত্রিকায় জোর করে আমাকে দিয়ে কয়েকটি লেখা লিখিয়েছিলেন। তাও আবার সাংবাদিকতার ওপর। কোন সালে তা মনে নেই। অন্য সব লেখার মতো এসব লেখাও হারিয়ে গেছে। তবে তিনটি বিষয়ের নাম এখনও মনে আছে, এক. সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়। দুই. নির্বাচনী রিপোর্টিং। তিন. মোবাইল ফোন ও সাংবাদিকতা। সম্ভবত বিষয় তিনটি এমন হবে। সাযযাদ ভাই না লেখালে হয়ত কোন দিন ওই ধরনের লেখা লিখতাম না। আমার কেন যেন মনে হয়, এসব লেখা আমার কাজ নয়। জীবনে সাংবাদিকতার বই তো কম পড়লাম না, কিন্তু এখনও একই দোলাচলে আসলে ওই বইগুলো কি কাজে লাগে না লাগে না? তাছাড়া সাংবাদিকতার জন্য ভালো বই লিখতে হলে অনেক সময় দিতে হয়। যাক এ গেল ভিন্ন বিষয়। তবে সম্পাদক হিসেবে সাযযাদ কাদির ভাই ছিলেন অনেক বড়। তিনি লেখা বের করে আনতে পারতেন। এমনকি তিনি আমাকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েও ছাড়িয়েছেন। লেখক, কবি, সম্পাদক সাযযাদ কাদিরের বাইরেও আরেক সাযযাদ কাদির ছিলেন। যিনি হলেন, বিচিত্র সব বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করা এক সাযযাদ কাদির। তার সেই সব বিচিত্র বিষয় নিয়ে কিছু বইও শেষের দিকে তিনি লিখেছেন। তবে ভাবতে অবাক লাগত, এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি কীভাবে নাড়াচাড়া করতেন। সাযযাদ কাদির ভাইয়ের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যের কী ক্ষতি হয়েছে তা সাহিত্যিকরা বলবেন। তবে সাংবাদিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে আমার । সাড়ে তিন দশকের বেশি এই সাংবাদিকতা জীবনের শুরুর দিন থেকেই কলাম লিখছি। এসব লেখায় কত মানুষের যে সাহায্য আছে তা বলা সত্যিই দুষ্কর। তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে এসব মানুষ দিন দিন একেক জন করে হারাচ্ছি। যেমন এক সময় লিখতে বসে গাজীউল হক, আতাউস সামাদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রমূখকে ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার দিন তারিখ নিয়ে জিজ্ঞেস করতাম। যে কোন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ প্রয়োজন মনে হলেই দ্বারস্থ হতাম শফিকুল আজিজ মুকুল ভাইয়ের। ওয়াহিদুল হক প্রমুখকে জিজ্ঞেস করতাম রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটি কোন কবিতার। এমনি অনেকে। দিন দিন আমার এ পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছে। তেমনি আমার পৃথিবীটাকে আরও ছোট করে চলে গেলেন সাযযাদ কাদির ভাই। আর ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারব না, সাযযাদ ভাই এটা রবীন্দ্রনাথের কোন কাব্যে বা রবীন্দ্র রচনাবলীর কোন্ খ-ে পাব? জীবনের খ-গুলো মনে হয় এমনই, প্রথমে থাকে, প্রভাতের রবির কর তার পরে ধীরে ধীরে এমনি করেই গোধূলির শূন্যতা বা নীরবতা নেমে আসে।
×