ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘কথা বলা মাছ’র সঙ্গে কথোপকথন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

‘কথা বলা মাছ’র সঙ্গে কথোপকথন

কবিতা ঘ্রাণ নেয়ার বিষয়, ডুবে থাকার বিষয়- কবিতা টানা আলোচনার বিষয়। অনেক সময় আলোচকের চোখ এড়িয়ে কবির ভাবনার বিষয়টি অধরা থেকে যায়। পাঠকের দরবারে তুলে ধরার আগে কবি তার আত্মজাকে যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করেন, পাঠকের কাছে সেই গোছালো অবয়বও অগোছালো মনে হয়। কবি কী বলতে চেয়েছেন তার থেকে পাঠক কী বুঝতে পেরেছেন সেটাই মুখ্য বিষয়। কথা বলা মাছ শিরোনামের কবিতার বইটি জিনাত জাহান খানের পরিশ্রমের ফসল। তার মতো করে তিনি সাজাতে চেয়েছেন কবিসত্তার দ্বিতীয় প্রকাশে। আর পাঠক হিসেবে আমার চোখ-মগজ খুঁজছে তুষ্ণার্ত জীবনের রসদ। কতটুকু পেলো কথা বলা মাছের সঙ্গে কথা বলতে বলতে- সেটাই উল্লেখ করার চেষ্টা করছি। চলমান সময়ের তরুণ কিংবা অতিতরুণদের চেষ্টার মতো নিরীক্ষামূলক কিছু না থাকলেও ভাললাগা বা ভাবনার মতো কিছু আছে জিনাত জাহান খানের চেষ্টায়। যখন তিনি বলেনÑ‘পড়শিহীন আমার আরশী নগর’ (বসতি)। তখন আমরা অপেক্ষায় থাকি তার একাকিত্বের ঘোরে ডুবরির চোখে নিজেকে ডুবিয়ে ২য় কিংবা তৃতীয় চোখকে আবিষ্কার করতে। ‘শিল্প’ কবিতায় ‘ঋতুমতি বালিকার সুগন্ধী রক্তদাগ’ পুরনো চিন্তা হলেও নিজেকে ভালবাসার অন্য রকম উচ্চারণ হিসেবে আমরা দেখি- বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা কথা শুনে বোঝা যায় তীব্র অসুখের কথা (অসুখের বার্তা) আসলে অসুখ কি কখনও খবর দিয়ে আসে! হয়ত, হয়ত না। কিন্তু অসুখের কথা আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপেই লেগে থাকেÑ মিশে থাকে প্রতিটি কাজের অভ্যন্তরে। কবির তৃতীয় চোখ এই দৃশ্যে নিজেকে ডুবিয়ে তার উপলব্ধির প্রকাশ করেছেন। ভাললাগার মতো এমন আরও কিছু পঙ্ক্তির পাঠ নেয়া যাক- * সন্ধি আসলে রোদ ও বৃষ্টির পালাক্রম (উড়ন্ত ফানুস) * ঘুড়ির সঙ্গে ইদানীং কপালে বিন্দু ঘাম আসে (বিনির্মাণ) * কপালে এত অন্ধকার নিয়ে/কোথায় চলেছ একা! (বিনয় মজুমদার) * আলোহীন মগজের কোষে কোষে/জমে থাকে, কিছু পুরনো শঙ্খরোদ (শঙ্খরোদ) চলমান সময়ের কবিতায় পরিপূর্ণ মেসেজের চেয়ে কবিতার কারিগররা চমক দেখাতে ব্যস্ত। কোন কোন লাইনই কবিতার মূল কেন্দ্র হয়ে থাকছে। কবি জিনাত জাহান খানের কবিতায় চমকটা তেমন একটা না থাকলেও অনেক কবিতায়ই পাঠক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে একটা তৃপ্তি পাবেন। পুরো একটা চিত্র পাঠককে নিয়ে যাবে কবিতার গহীনে। তবে কিছু কবিতায় লাইনে বর্ণনার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। কবিতার মধ্যে দর্শন-বিজ্ঞান কিংবা সমাজভাবনার বিচিত্র সব বিষয় তিনি সরাসরি উপস্থাপন করেননি। তার কবিতার বইয়ের নামের মধ্যে যে ভিন্ন উচ্চারণ, লেখায় তেমন ভিন্ন উচ্চারণ না থাকলেও ‘কথা বলা মাছ’ শুরু থেকে শেস পর্যন্ত সাবলীলভাবে কথা বলে গেছে। কখনও প্রকৃতি কখনও মানুষের অভ্যন্তরীণ পরিভাষার ছবি এঁকেছেন। উপমা আর চিত্রবলা ‘কথা বলা মাছ’কে সফল বলতে পারি। অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উপমাকে ব্যবহার করে কবিতার শরীরকে সাজিয়েছেন। চিত্রকলায় অষ্ঠাদশী কবিতাকে প্রাণ দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রচলিত ছন্দকে এড়িয়ে এই কাব্যের অধিকাংশ কবিতাও সুরে তৃষ্ণা, পাওয়া-না পাওয়ার ছবি। প্রতিবেশী জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখাতে চেয়েছেন কবি, কখনও কখনও কোন কবিতার শিরোনামই পূর্ণাঙ্গ কবিতা হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন, একটি কবিতার শিরোনামÑ‘সক্রিয় পাখিদের মতো আমার কোন অন্দর মহল নেই।’ ‘কথা বলা মাছ’ বইয়ের স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কিছু কবিতা বেমানান মনে হয়েছে। সময়ের সঙ্গে অন্যান্য সবল কবিতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে পিছলে পড়তে পারে সেগুলো। কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন হলে হয়ত এমনটা হতো না। জিনাত জাহান খানের ২য় প্রয়াস গতিমত দিনপাত করবে। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবে এটা আমার বিশ্বাস। শেষ করি বইয়ের প্রথম কবিতা দিয়ে যেখানে কবি জীবনের আবর্তনের কথা বলেছেন মনে হলো এক বাক্যেইÑ ‘কোন সরীসৃপ যাত্রাই অনিশ্চিত নয়’ (যাত্রা)। সানাউল্লাহ সাগর
×