ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৌম্য সালেক

শান্তনু কায়সার মননের অনুপম শিখা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

শান্তনু কায়সার মননের অনুপম শিখা

মহৎ কবি ও লেখকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন মননশীল সমালোচকের। কবি ও শিল্পীর সৃজন কিংবা সম্পন্নতার বিষয়ে পাঠক বোদ্ধা সমালোচকের মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি রাখেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম বিস্তর আড়াল থেকে কেবল সমালোচকের যথার্থ আলোচনার প্রেক্ষিতে পুনরায় সাদরে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রযুগের কয়েকজন বিজ্ঞ আলোচকের নাম পাঠে আনতে পারি, তারা হলেন- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য ও আজিত চক্রবর্তী। এর পরবর্তী পর্যায়ে সমালোচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন- অতুলচন্দ্র গুপ্ত, শ্যামাপদ চক্রবর্তী, ড. শশিভূষণ দাসগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, সুবোধ সেনগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী, নীহাররঞ্জন রায়, প্রমথ চৌধুরী এবং আবদুল কাদির। বিংশ শতাব্দীতে সমালোচকের আধুনিক, সূক্ষ্ম ও তীর্যক দৃষ্টিতে যারা শিল্পমূল্যায়নে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন তারা হলেন বুদ্ধদেব বসুু, সৈয়দ আলী আহসান, মধুসূদন বসু, আহমদ শরীফ, মোবাশ্বের আলী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আজাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম এবং আনিসুজ্জামানের নাম বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য। শান্তনু কায়সার (১৯৫০-২০১৭) সেই প্রাজ্ঞ সমালোচকদেরই একজন যার কাছে সাহিত্য মূল্যায়িত হয়েছে কেবল শিল্পমূল্য, আঙ্গিক ও সমষ্টিচেতনার ভিত্তিতে। অন্য কোন প্রভাবক তার সাহিত্য মূল্যায়নে বিবেচনায় আসেনি। একজন সমালোচকের শিল্প-সাহিত্য মূল্যায়নের যে দায়বোধ থাকে তা তিনি যথার্থ মাত্রায় প্রতিফলনে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। শান্তনু কায়সারের প্রধান পরিচিতি প্রাবন্ধিক, গবেষক কিংবা সমালোচক হলেও সৃজনশীল সাহিত্য ধারার প্রায় সব ক’টি অংশেই তিনি সক্রিয় ছিলেন। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটি ছিল একটি কাব্যÑ ‘রাখালের আত্মচরিত’ (১৯৮২), পরবর্তীতে ২০০২ সালেÑ ‘শুভ সুবর্ণজয়ন্তী’ শীর্ষ নামের আরও একটি কাব্য তিনি প্রকাশ করেন। তার রচিত গল্প সঙ্কলনগুলো হচ্ছেÑ শ্রীনাথ পি তের প্রাণপাখি (১৯৮৭), ফুল হাসে পাখি ডাকে (২০০১) এবং অর্ধ শতাব্দী। ‘ঐ নূতনের কেতন উড়ে’ এবং ‘শকুন’ শিরোনামের দুটি উপন্যাস ছাড়াও তার একটি ত্রয়ী উপন্যাসিকা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে ‘তুমি’, ‘সাজনমেঘ’, ‘রূপান্তর’ ও ‘আমরা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া অদ্বৈত মল্ল- বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’Ñ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেনÑ শান্তনু কায়সার। অনেক ছোটকাগজ ও বিশেষ সংখ্যার পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেছেনÑ খান মোহাম্মদ ফারাবী রচনা সমগ্র, তিতাস একটি নদীর নাম ও মতিউল ইসলাম স্মারকগ্রন্থ (১৯৮৫)। শিশুদের নিয়ে তিনি ২০০১ সালে লিখেছেনÑ ‘ছোট বন্ধুরা’ নামের একটি গ্রন্থ। জীবনীগ্রন্থ রচনার দিকেও তার বিশেষ ঝোঁক ছিল; তিনি লিখেছেনÑ অদ্বৈত মল্ল-বর্মণ, মতিউল ইসলাম, মোহাম্মদ মোর্তজা, রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী, শওকত ওসমান, মীর মশাররফ হোসেন, নাজমা জেসমীন চৌধুরী এবং আরজ আলী মাতুব্বর এর জীবনী। অনুবাদ করেছেন রবার্ট ব্রাস্টেইনেরÑ বিদ্রোহী নাট্যতত্ত্ব : ত্রয়ী নাট্যকার এবং লোপে দ্য ভেগার নাটকÑ ফুয়েন্তে অভিজুনা। তার সাহিত্য সাধনার প্রধান কার্যক্ষেত্র ছিল প্রবন্ধ ও গবেষণা, সেখানে তিনি অনেক মূল্যবান ও অবিকল্প গন্থ রচনা করেছেনÑ যার কয়েকটি হচ্ছেÑ বঙ্কিমচন্দ্র (দুই পর্বে প্রকাশিত), সুকান্ত ভট্টাচার্য, কাব্যনাটক, তৃতীয় মীর, গভীর গভীরতর অসুখ : গদ্যসত্তার জীবনানন্দ, বাংলা কথাসাহিত্য : ভিন্ন মাত্রা, ফুল ও নজরুল, স্বর্ণ ও শুভ, সুকান্ত ভট্টাচার্য : পাঠ ও পুনর্পাঠ, রবীন্দ্রনাথ : চার অধ্যায়, সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ : না নিন্দা না স্তুতি না দূষণ এবং তৃতীয় প্রজন্মের কাছে। শান্তনু কায়সারের গ্রন্থসংখ্যা পঞ্চাশের মতো। এ ছাড়া সমাকালীন পত্রপত্রিকায় তার শতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত রয়েছে, যা গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি প্রবন্ধে বিশেষ অবদানের জন্য- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৪ লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি আরও কিছু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন সেগুলো হচ্ছেÑ প্রত্যাশা সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯০, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯৫, অদ্বৈত মল্ল-বর্মণ স্মৃতি পুরস্কার (ভারত)-১৯৯৯, কুমিল্লার কাগজ পুরস্কার-২০০৫, অদ্বৈত সম্মাননা (বি.বাড়িয়া)-২০১৩; জীবনানন্দ পুরস্কার-২০১৩ এবং ইলিশ উৎসব সম্মাননা-২০১৫। বাংলা সাহিত্যের ব্রাত্যজনের প্রধান প্রতিনিধি অদ্বৈত মল্ল-বর্মণকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে শান্তনু কায়সারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে যুক্তি ও শিল্পের অনুষঙ্গে নতুন করে অদ্বৈত মল্ল-বর্মণকে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন। ছাত্রজীবন থেকে শান্তনু কায়সার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ ২০১২ সালে মাত্র চারজন সঙ্গী নিয়ে তিনি কুমিল্লায় গড়ে তোলেন ‘সমতট’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংগঠনটি ২০১৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্রকাশনাসহ চারটি স্মারক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শান্তনু কায়সার সম্পাদিত সমতটের চতুর্থ প্রকাশনায় (২০১৫) আমরা অদ্বৈত মল্ল-বর্মণের একটি দুর্লভ ও অপ্রকাশিত ছোট গল্প পাই যার শিরোনামÑ ‘তমোনাশের মন।’ এই গল্পটি অদ্বৈত মল্ল-বর্মণের রাচনাসমগ্র কিংবা অন্য কোন সঙ্কলনে গ্রন্থবদ্ধ নেই। শান্তনু কায়সারকৃত সমতটের প্রারম্ভিক প্রস্তাবনাটিও ছিল অত্যন্ত অভিনব এবং শিল্পবদ্ধ : ‘সংস্কৃতি আমাদের কাছে শুধু ফলিত ও প্রদর্শিত কলা নয়। বৌদ্ধিক উৎকর্ষ ও বহমান জীবনের বৃহত্তর ও নান্দনিক প্রকাশও বটে। দুই শান্তনু কায়সার ১৯৫০ সালের ৩০ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সাচানমেঘ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম ছিল মোঃ আবদুর রাজ্জাক। আপন প্রচেষ্টায় তিনি পারিবারিক নাম ও পরিচয়ের গি পেরিয়ে, গৃহীত শান্তনু কায়সার নামকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি সরকারী কলেজে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হন। ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষক হলেও তিনি আমৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তার কর্ম জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কুমিল্লায়। কুমিল্লার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি এতই গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন, কেউ এটা ভাবার অবকাশ পায়নি যে, তিনি অন্য কোন জেলার লোক। লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি যেমন বস্তুনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী ছিলেন তেমনি অনুষ্ঠানে বিষয়ে নির্ভর বক্তব্য প্রদান কালে তাকে দেখেছিÑ অনর্গল তথ্য, তত্ত্ব ও বুদ্ধির অপূর্ব সমাবেশ করে জমিয়ে কথা বলছেন। ২০০৬ সাল থেকে আরম্ভ করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে আমি তার অনেক বক্তব্য শোনার সুযোগ পেয়েছি। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে পরে, সেটা ২০১০ সাল। একদিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মুজিবুর রহমানসহ আমরা তার অশোকতলার বাসায় দেখা করতে যাই। সেদিন সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে নয়টা অবধি বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথকতা জমে ওঠে। তিনি সত্য প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন না, এ জন্য অনেকের চোখে বিরাগভাজন হয়েছেন; আবার স্পষ্ট কথা বলার ফলে তাকে দেশের দুর্গম, দূরবর্তী স্থানে বেশ কয়েকবার বদলিও করা হয়। অবশ্য এতে তার সৃষ্টিশীলতায় যে খুব ছেদ পড়েছে তা কিন্তু নয়; যেখানেই গেছেন সেখানেই সৃজনশীলতার সক্ষমতা তাকে দিয়ে কিছু না কিছু করিয়েছে। প্রথম দিনেই আমি বুঝেছি, তার কাছে যা যুক্তির মাপে উত্তীর্ণ বা স্পষ্ট তা বলতে তার বুক কাঁপে না। তিনি সমালোচনা করে সেদিন বলেছিলেনÑ ভিক্টোরিয়া কলেজে বৃথাই নজরুল ও আক্তার হামিদ খানের নামে সম্মানসূচক চেয়ার সৃষ্টি করা হয়েছে। যেখানে বছরের পর বছর কোন চেয়ারপার্সন নেই কিংবা কোন প্রকার কর্মসূচী নেই সেখানে এসব বৃথাই বলে বেড়ানো হচ্ছে। সেদিনের কথকতার মধ্যেই দেখেছি তিনি কেবল সাহিত্য চিন্তার মধ্যেই নিবিষ্ট নন, বরং সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়েও তিনি ব্যথিত ও চিন্তিত। চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে তার মন্তব্য ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক : ‘বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত ৫৫ ভাগ কোটার বাস্তবতা লাখ লাখ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে আমাদের যে কতটা করুণ ও নিচু করে তুলে ধরছে, তা যে কবে জাতি উপলব্ধি করবে জানি না।’ প্রথম পরিচয়ের পর থেকে স্যারের সঙ্গে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চাকরিগত কারণে ২০১৩ সাল থেকে চাঁদপুরে থাকছি; কিন্তু মাঝে মাঝে যখনই কুমিল্লা গিয়েছি স্যারের সঙ্গে সাক্ষাত ছাড়া ফিরিনি। মুঠোফোনে তার সঙ্গে নিয়মিতই কথা হতো। গত ডিসেম্বরে তিনি পুত্র-কন্যার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সফর করেন; সেখান থেকেও তিনি মাঝে মাঝে কল করতেন। একদিন তার বিশেষ প্রয়োজনে আমি কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর (৮নং সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধ-১৯৭১) ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দেই। তিনি শেষ দিকে কুমিল্লা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছিলেন; পরে বুঝেছি যে, ওই গ্রন্থের প্রয়োজনেই আবু ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে তার কথা বলতে হয়েছে। একবার তার বিদেশে অবস্থানরত পুত্রের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদের প্রয়োজন পড়ে, সেক্ষেত্রে চাঁদপুরে থাকার সুবিধায় কাজটি সমাধানের সুযোগ পেয়েছি। বর্তমানে আমাদের সাহিত্যে উপযুক্ত সমালোচকের বেশ অভাব রয়েছে। যারাই আলোচনা করছেন, তারা হয় দায়সারা কিছু বলে দিচ্ছেন, না হয় অযৌক্তিক বা অর্থহীনভাবে কেবল খুশি করার তাগিদে একপ্রস্থ লিখে দিচ্ছেন। শান্তনু কায়সার ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তার নিপুণ নিক্তিতে যা কিছু সুন্দর বা অসুন্দর ঠেকেছে তাই তিনি বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে অকপট প্রকাশ করেছেন। একবার তার কাছে শুনেছি যে, কবি আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন যা নাকি আল মাহমুদকে চরম আহত করেছে। পরে আবার আল মাহমুদ শান্তনু কায়সারকে বলেছেন যে, শান্তনু তুমি ওই রচনাটি কোন একটি গ্রন্থে দিয়ে দিও। শান্তনু কায়সার সেই রচনাটি ‘স্বর্ণ ও শুভ’ গ্রন্থে প্রত্রস্থ করেছেন। আমার কবিতাগ্রন্থ ‘আত্মখুনের স্কেচ’ সম্পর্কে তাঁর কাছে একবার মন্তব্য জানতে চেয়েছি। তিনি বলেছেন, ‘সৌম্য, তোমার কবিতা নিয়ে এখন কিছু বলতে চাই না, আমি পিয়াস মজিদকেও এ কথা বলেছি। তবে তোমাদের কবিতা নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছে আছে।’ আমার সৌভাগ্য হয়েছে শান্তনু কায়সারের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে দু’কথা বলার; সেটা ছিল ২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত, ‘হাজেরা হাসমত ফাউন্ডেশন’-এর বই পড়া কর্মসূচীর পুরস্কার বিতরণী ও রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীর একটি অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের মান জাগানো কথামালায় তিনি বলেছিলেনÑ বীর দুই প্রকার- একদল বীর হয় যোদ্ধারা, আরেক দলেÑ শিল্পী, কবি তথা জ্ঞানীরা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক (নাইট) বীর উপাধি পেয়েছিলেন আবার স্বদেশ ও স্বজাতির প্রয়োজনে সেটা প্রত্যাখ্যানও করেছিলেন। ‘অন্তিম যাত্রার প্রস্তাব’ এবং ‘রাখালের আত্মচরিত’সহ তিনি বেশকিছু শিল্পসম্মত কবিতা রচনা করেন। দীর্ঘ বিরতির পরে তিনি সর্বশেষ কবিতাটি লেখেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের অনুরোধে, ছোটকাগজ মৃত্তিকার জন্য। লেখাটি চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির বার্ষিক মুখপত্র ‘উছল’-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হচ্ছে। ‘মধুদা, শুনতে পাচ্ছো’ শিরোনামের কবিতাটির এক স্তবক এখানে তুলে ধরেছি : ‘মধুদা শোনো, একাত্তরে আমিই শুধু লিখিনি বাংলাদেশের সমর্থনে/ আরও কবিতা লিখেছে পাকিস্তানের নানা অংশের জনগণ/ আমি নিজে সংগ্রহ করেছি/ সিন্ধি ভাষায় লেখা অন্তত দু’শ’/ পশতুতে কমপক্ষে পঞ্চাশ/ এবং বালুচ ভাষায় অন্তত বিশটি কবিতা/ অতএব বুঝেছো মধুদা/ একাত্তরে, যদিও কামরুল হাসান/ ছবি এঁকে বলেছিলেন/ এই দানবদের হত্যা করতে হবে/ তবু আমরা বলি/ মানুষরা সর্বত্র আমাদের বন্ধু/ কবির সোনার বাংলায় তাই / মনুষ্যবিরোধী কারও অথবা কোন কিছুর/ ঠাঁই নেই এবং ঠাঁই হবে না।’ যে যুগে কাজের চেয়ে কোলাহল আমাদের বেশি আঁকড়ে ধরছে, যে সময় ভাব ও চিন্তাকে বাদ রেখে আমাদের যন্ত্রদানবের গতিতে ছুটে নিয়ে যাচ্ছে, যে সমাজ সৃজন-বীক্ষণের চেয়ে অর্থ ও বস্তুকে অধিক মূল্য দিচ্ছে; সে যুগ, সময় ও সমাজের মধ্যেই আমরা শান্তনু কায়সারকে পেয়েছি। এ থেকে বুঝতে পাই যে, ব্যক্তির লক্ষ্য ও আত্মবিশ্বাস যদি স্থির ও সংহত হয় তবে কোন প্রভাবই পথচলায় বিচ্যুতি ঘটাতে পারে না। গত ১১ এপ্রিল আমরা শান্তনু কায়সারকে হারিয়েছি। তার দেহ লোকান্তরে গেছে, কিন্তু মননের অনুপম শিখা সমান যে দীপ তিনি রচনা ও কথকতার মধ্যে জ্বালিয়েছেন; শিল্প ও সৃজনের আয়োজনে প্রয়োজনে তা আমাদের উপযুক্ত আলো দেবে এবং সে আলোক প্রাঙ্গণে শান্তনু কায়সারের নাম উচ্চারণ হবে; তবে এ কথা হবে না : তিনি তো আর নেই।
×