ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

শরৎ সাহিত্যে নারী চেতনা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

শরৎ সাহিত্যে নারী চেতনা

নারীর প্রতি দায়বদ্ধতা, মমতা আর বেদনাঘন আর্তিতে যে কয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব নিজেদের সৃজনশীলতাকে নিরন্তর সজাগ রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়। তার সাহিত্যের বিচিত্র ধারায় গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে যেভাবে নারী স্বাধীনতা, অধিকার এবং মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। প্রচলিত সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে নারীর আধুনিক চেতনা এবং সম্মানের ব্যাপারে তিনি কখনও আপোস-মীমাংসায় আসেননি। দুর্বার আক্রমণে সমস্ত সামাজিক অফশাসনকে বিদ্ধ করেছেন, শ্লেষাত্মক বাক্যবাণে জর্জরিত করেছেন সর্বোপরি অধিকার আদায়ের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নেমেছেন। তার বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে সমাজের নানা অপসংস্কারের নির্মম চিত্র তো আছেই। আরও স্পষ্ট এবং বেশি করে ভাবার অবকাশ পেয়েছেন ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে। নারীকে মানুষ ভাবার যে যৌক্তিক এবং প্রত্যাশিত আবেদন সেটাই ছিল এই অমর কথাশিল্পীর বিভিন্ন আলোচনার মূল বার্তা। উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্যগগনে শরৎচন্দ্রের জন্ম ১৮৭৬ সালে। বিদ্যাসাগর এবং রাজা রামমোহন রায়ের নতুন চিন্তায় পথচলা পরবর্তী প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত এবং প্রাণিত করে। সেই সময়ের নতুন প্রজন্মের উত্তরসূরি শরৎচন্দ্র নারী অধিকার আর মর্যাদা রক্ষায় সমাজ ব্যবস্থার মূল রক্ষণশীল ধারাকে তীক্ষè বিদ্রƒপে কটাক্ষ করেছেন। শুধুমাত্র নারীর ক্ষেত্রে যে সামাজিক অভিশাপ চাপানো হয়েছে সেই পাঁক থেকে নারীকে তুলে আনতে যা যা করার দরকার ছিল সবই করেছেন। তার সাহিতের নারীরা সামাজিক আবর্জনার আবর্তে জড়ালেও নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা এবং মানবিক মূল্যবোধে সেখান থেকে তাদের সযতœ পরশে রক্ষাও করেছেন। সে কোন্ বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে তার নারী চেতনায় বিকিরণ আজ শতবর্ষ পরেও সে আবেদন নতুন মাত্রায় জেগে ওঠে। বিভিন্ন ধর্মের অনমনীয় নিয়মশৃঙ্খল নারীর এগিয়ে চলার পথকে যেভাবে কণ্টকাকীর্ণ করেছে দৃপ্ত পায়ে এবং দৃঢ়চিত্তে সে সব আবর্জনাকে নিমূল করতে এই বরণীয় কথাসাহিত্যিক যা করেছেন তা আজও আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে। রাখ, ঢাক নয় অত্যন্ত সচেতন এবং স্বচ্ছভাবে যে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন তার সৃজন সম্ভারের আনাচে-কানাচে সেখান থেকেই তার যথার্থ মূল্যায়ন আজও তাকে সম্মানের শীর্ষে দাঁড় করায়। সমাজ ব্যবস্থার অসহনীয় দুর্বিপাকে পড়া তার সৃষ্ট নায়িকাদের বেহাল অবস্থা দৃশ্যমান হলেও শেষমেশ আপন মর্যাদায় তারা জীবনের যথার্থ গতিপথ খুঁজে পায় এবং নিজের মতো করে তারা বাঁচেও। বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, গুটিকয়েক বিখ্যাত নায়িকার চরিত্রের যৌক্তিকতায় এসব সত্য পাঠকের কাছে সমাদৃত হয় যা সময়ের পরিবর্তনেও অম্লান। ‘বড় দিদি’, ‘মেজ দিদি’, ‘বিন্দুর ছেলে’ কিংবা ‘রামের সুমতির’ মতো বড় গল্পেও নারী চরিত্রের যে দৃঢ়তা, অনমনীয় ব্যক্তিত্ব সর্বোপরি আপন মর্যাদায় টিকে থাকার যে বোধ যার আবেদন আজও আমাদের উদ্দীপ্ত করে, যার গ্রহণযোগ্যা কিছুমাত্র কমে না সেটাই এই বিশিষ্ট সাহিত্যিককে শক্ত আসনে প্রতিষ্ঠিত করায়। তিনি অসংখ্য পাঠক সমাজের কাছে চিরদিনের বার্তাবহ হিসেবে আপন বৈশিষ্ট্য স্থিত থাকেন। আর ‘গৃহদাই, ‘দত্তা’, ‘ দেবদাস’-এর মতো সাড়া জাগানো উপন্যাসের নায়িকারা আজও পাঠক সমাজের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। নারী চেতনা শাণিতকরণে এমন নিবেদিত স্রষ্টা বাংলা সাহিত্যে হাতেগোনার মতো। শরৎচন্দ্র উনিশ-বিশ শতকের সেই সব বিশিষ্টজনের একজন যিনি কালজয়ী প্রতিভা এবং সৃষ্টিশীল উদ্যামে আজও পাঠকদের মাতিয়ে যাচ্ছেন। তার রচিত গল্প আর উপন্যাসে প্রসঙ্গক্রমে নারী ব্যক্তিত্ব এবং চেতনাকে বিধৃত করা হয়েছে সেখানেও শরৎচন্দ্রকে প্রচলিত শাসন, সমাজ এবং গতানুগতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। নারীকে সসম্মানে নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে এই অনন্য কথাসাহিত্যিককে রীতিমতো সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে হয়েছে। কোন অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক বিধিনিষেধের জালে তার সৃষ্ট নারীরা পড়লেও অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং সৃজনশীল দক্ষতায় লেখক তাদের মুক্ত করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেন। নারী বিষয়ক বিভিন্ন সূচকে সেই চিরাচরিত প্রথা বাল্যবিবাহ, অকাল মাতৃত্ব, অপরিণত জীবনযুদ্ধ সর্বোপরি বিধবাদের করুণ দুর্গতিই তার সাহিত্যের অন্যতম প্রতিপাদ্য পর্যায়। যেখানে সাহিত্যিকের সৃজন ক্ষমতা নারী চরিত্রের গতি নির্ণয় করে এবং পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। আর চিন্তাশীলতা কিংবা মননশীলতায় যুক্তিনির্ভর আলোচনা, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তার আদর্শিক চেতনা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তার লেখা ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধটি সেই সম্ভাবনারই দিক নির্দেশ করে। এখানেও সমাজ ব্যবস্থার কঠোর নিষ্পেশনে নারীর যে অসহায়ত্ব সেটাই পুরো প্রবন্ধটির মূল নির্যাস। বাল্যবিবাহের কবলে পড়া অবোধ বালিকাদের আর্তনাদ, অকাল মাতৃত্বে নারীর জীবন সংগ্রামের কঠোর আখ্যান-শিক্ষা নামক প্রয়োজনীয় পর্যায়টি নারীর জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সর্বোপরি অকাল বৈধব্যের নির্মম পোষণ নারী জাতির দুঃসহ অভিযাত্রার করুণ এবং বিপন্ন অবস্থা তার সুচিন্তিত ভাবনার জগতকেও নানাভাবে তাড়িত করে। তারই সুসংবদ্ধ রচনাশৈলী শরৎচন্দ্রের এই ‘নারীর মূল্য’ আলোখ্যটি। কিভাবে জন্ম থেকে নারীরা সমস্ত সামাজিক দলনকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়, সবার সঙ্গে আপোস করে সংসারে টিকে থাকে, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কোন রকম উচ্চবাচ্য করে না সেটাই তার যুক্তিশীল মতামতে প্রবন্ধটিতে উঠে আসে। এখানে শ্বশুরবাড়ি কিংবা বাপের বাড়ির ফারাক তেমনভাবে দৃষ্টিকটু না হলেও নির্যাতনের মাত্রাটা স্বামীর সংসারেই বেশি বলে মনে করা যায়। মানবিক এবং সহানুভূতিশীল লেখক শরৎচন্দ্র পারিবারিক অত্যাচারের মাত্রা, অপেক্ষা সামাজিক নিয়মবিধির শৃঙ্খলে পড়া নারী সমাজের নির্মম চিত্র এবং অসহায়ত্বকেই বেশি গুরুত্ব দেন বলে মনে হয়। সেটা তার সৃজনশীলতা কিংবা মননশীলতায় যাই হউক না কেন পারিবারিক এবং মনোজাগতিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা এবং অনুভবের মাত্রায় শরৎচন্দ্রের নারী চেতনা ভিন্ন মাত্রা দাবি করে। সমাজের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এত বেশি বলতে হয়েছে তাকে মানুষের সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক চিরায়ত অনুভূতিকে সেভাবে হয়ত নাড়া দেয়া সম্ভব হয়নি। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস পড়ে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে বলেছিলেন তুমি শুধু উপস্থিত কালের প্রয়োজন মেটাচ্ছ, ভাবী কালের জন্য কিছুই রেখে যাচ্ছে না।’ যে উপন্যাসটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল ‘সময়ের দাবী’, যুগের চাহিদা কিংবা মানুষের প্রয়োজনে সমাজ একদিন পরিবর্তন হবেই কিন্তু জীবনের চিরায়ত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষার নির্মল অনুভূতিগুলো কালের পরিবর্তনেও কোন রকমফের হবে না। তার পরেও বলা যায় শরৎচন্দ্র আজও পাঠক সমাজকে তাড়িত করে, তার সৃষ্টিশীল আবেদন এখনও পাঠকের চাহিদাকে প্রভাবিত করে, তার দেয়া বার্তাগুলো সময়ের ব্যবধানেও উজ্জ্বল এবং অম্লান।
×