ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মলয় বিকাশ দেবনাথ

আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার

২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল আকস্মিক দুর্ঘটনায় আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দেশের একজন নিবেদিত প্রাণ উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, নারী অধিকার যোদ্ধা, এ্যাকশন এইডের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর নাসরিন হক। যিনি সচেতন, আন্তরিকভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ দেশের অসহায়-নির্যাতিত নারী ও অন্য প্রান্তিক মানুষদের আইনগত অধিকার, নাগরিক, স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই করে গেছেন। ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষ করে নাসরিন বিদেশে অবস্থান না করে দেশে ফিরে এসেছিলেন শুধুমাত্র দেশের অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত, নির্যাতিত নারী-পুরুষের কথা ভেবে। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইন তৈরি এবং এসিড আক্রান্তদের সাংগঠনিক এবং ব্যক্তিগতভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস, জ্বালানি রক্ষা আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশের স্বার্থে তার দৃঢ় অবস্থান ছিল বিদেশী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। এসব ক্ষেত্রে তার কমিটমেন্ট এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ এবং নারী স্বাস্থ্য ও প্রজনন অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এই সংশোধনীর প্রভাবে অন্য ধর্মের মানুষের নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাওয়ার বিষয়টির কথা। তিনি সে বছরই বিজয় দিবসকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধে হারানো স্বজনদের স্মরণে শহীদ মিনারে ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ শিরোনামে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচী প্রবর্তন করেছিলেন। যা এখনও চলছে। ১৯৯১ সালে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদের সময় তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের কাউন্সিলর মেহরবা মুক্তি বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার পর তার সহযোগিতা আমার জীবনটা বদলে দিয়েছিল। শুধু আমার নয়, এসিডে আক্রান্ত আমার ছোট বোনের জীবনটাও। সবকিছু ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছি আমরা দুই বোন। দুর্বৃত্তরা আমাদের থামাতে পারেনি। যে লাঠিতে ভর দিয়ে আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি সেই লাঠি নাসরিন হক আজ হারিয়ে গেছেন। কিন্তু লাঠি ছাড়া হাঁটার সাহস তিনিই আমাদের দিয়ে গেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বহুজনকে বেঁচে থাকার পথ দেখানো নাসরিন হক বেঁচে আছেন এবং থাকবেন তার কাজের জন্য। বেঁচে থাকবেনÑ জীবন ফিরে পাওয়া, উঠে দাঁড়ানো নির্যাতিত বহু মানুষের মনে। তারই দর্শনে উজ্জীবিত ছোট্ট কিশোরী মাদ্রাসা ছাত্রী সোনিয়া নিজের বিবাহ ঠেকিয়ে দৃষ্টান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার উজানপাড়া এতিমখানা আলিয়া মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। কাঠমিস্ত্রি বাবা অভাবের তাড়নায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে কিন্তু যে এ্যাসেম্বলিতে সবাইকে শপথ পড়ায় বাল্যবিয়েকে না বলতে শিখায়, সেই কি না শিকার বাল্যবিয়ের। প্রতিবাদ করে এবং ত্রিশালের নির্বাহী কর্মকর্তা তার বাবা ও সোনিয়াকে ডেকে এ বিয়ে বন্ধ করান। এদিকে ১৫ বছর বয়সে শারমিন জোরপূর্বক বিয়ে ঠেকিয়ে সারা বিশ্বের কিশোরীদের সামনে এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ এ্যাওয়ার্ড’ ‘সাহসী নারী’ পুরস্কার দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি থমাস শ্যাননের উপস্থাপনায় ২৯ মার্চ ২০১৭ ওয়াশিংটনের ডিন এসেন্স মিলনায়তনে ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের হাতে থেকে শারমিন পুরস্কার তুলে নেয়। ওই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের আরও ১২ জন নারীকে এ সম্মাননা দেয়া হয়। গত বছর বাংলাদেশের আইনজীবী সারা হোসেন এ পদক পেয়েছিলেন। তার পূর্বে ২০১৩ সালে ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক নাদিয়া শারমীন। তার সাহসিকতার জন্যও তিনি এ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। নারীদের এই এগিয়ে চলাতে সামাজিক সমর্থন জোগানই রাষ্ট্র তথা সমাজের কর্তব্য।
×