ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যৌতুক নিরোধ আইন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

যৌতুক নিরোধ আইন

যৌতুক প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক সামাজিক ব্যাধি। এই পণ প্রথার আবর্তে শুধু অসহায় মেয়েরাই বিপন্ন অবস্থার শিকার হয় তা নয়Ñ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতারাও এই নির্মম অপসংস্কারের বলি হয়। দীর্ঘদিন ধরে সদর্পে টিকে থাকা এই অবর্ণনীয় দুর্বিপাক থেকে বের হয়ে আসার বিকল্প পথ হিসেবে বিভিন্ন আইনী ব্যবস্থাকে সংযুক্ত করা হলেও একে নির্মূল করা আজও সম্ভব হয়নি। প্রতিনিয়তই এই অমানবিক অব্যবস্থার রোষানলে পড়া নারীরা যে দুর্ভোগে পড়ে তা যেমন পাশবিক একইভাবে ধিক্কৃতও বটে। বিভিন্ন সময়ে এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও এ ধরনের অশুভ মনোবৃত্তিকে থামানো যায়নি। তার পরেও রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে যারা থাকেন তাদের ওপর এক ধরনের দায়বদ্ধতা থাকে সামাজিক ব্যাধিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার আইনসিদ্ধ নীতিমালা প্রণয়নে। সেই লক্ষ্যে ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৭’-এর নতুন বিধিমালা তৈরিতে সরকার কর্তৃক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৭’-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর আগে ১৯৮০ কিংবা ২০০০ সালের আইনী ধারায় নারী ও শিশুরা বিচারের প্রার্থী হয়ে মামলা দায়ের করতে পারত। যদিও এসব মামলার সিংহভাগেরই কোন সুরাহা হতো না। নারী নির্যাতনে দায়ের করা বিভিন্ন বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার জালে থমকে যায়। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায্য বিচার পায় না এবং অভিযুক্তরা বেমালুম পার পেয়ে যায়। আসলে আইনী ব্যবস্থায় কোন প্রথা কিংবা অসামাজিক প্রক্রিয়াকে সেভাবে মোকাবেলা করাও যায় না। তার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা এবং মানবিক মূল্যবোধ। তার পরেও নতুন আইনে নতুন কোন সম্ভাবনা অসহায় নারীর আসলে কোন পথ দেখাবে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। নতুন এই আইনের ধারায় উল্লেখ আছে কোন মেয়েকে যৌতুকের জন্য যদি মারাত্মক জখম করা হয় তাহলে অভিযুক্তদের যে শাস্তিপ্রাপ্য তা হলোÑ যাবজ্জীবন কারাদ- কিংবা অনুর্ধ-১২ বছরের সশ্রম কারাদ-। এ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং সারা জীবনের ভরণপোষণেরও বিধান রাখা হয়। নির্যাতিত নারীর আঘাত যদি সামান্য হয় তাহলে অপরাধীকে ১ থেকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদ-সহ অর্থ দ-েরও বিধান রাখা হয়। যৌতুকের কারণে কোন মেয়ে যদি আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় তাহলে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদ-ের সঙ্গে আর্থিক অনুদানেরও সুপারিশ করা হয়েছে। ২০০৩ সালে সংশোধিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন’ আইনে সশ্রম কারাদ-ের সঙ্গে মৃত্যুদ-ও সংযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান আইনে মৃত্যুদ- রহিত করা হয়। এসব আইনের দায়বদ্ধতায় অপরাধপ্রবণতা যে কমে না তা সবাই সব সময়ই প্রত্যক্ষ করে। আইন চলে তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়। কিন্তু সমাজের কঠোর এবং অপ্রতিরোধ্য এসব প্রথাকে নিশ্চিহ্ন করতে গেলে জোটবদ্ধ আন্দোলন অনস্বীকার্য। সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং জোরালো আবেদনে এ প্রথাকে সামাল দেয়া খুব বেশি কষ্টকর হবে না। এর জন্য সব থেকে জরুরী নারীর প্রতি সম্মানবোধ, নারীকে মানুষ ভাবার সচেতন মানসিকতার সঙ্গে অর্ধাংশ নারী জাতিকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা। আরও প্রয়োজন বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক আবর্জনাকে শক্তভাবে ঠেকানো, শিক্ষা এবং পেশায় নিজেকে যোগ্যতম জায়গায় নিয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। স্বনির্ভর এবং শিক্ষিত নারীরা অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হলেও তার মাত্রা অনেকটাই কম হয়। তার ওপর মামলা করা বিচারিক প্রক্রিয়ায় জটপাকানোর যে দুরভিসন্ধি সেটাও নির্যাতিতকে দুর্ভোগের কবলে ফেলে। আর এসব থেকে মুক্ত হতে না পারলে আইনী ব্যবস্থার সুফল পেতেও বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই আদালতের পরিবেশ ও নারীবান্ধব হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও এক্ষেত্রে বিশেষ জরুরী। ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৭’-এর নতুন ভাবে সংযোগ করা বিধিনিষেধ নারীদের জীবনযাত্রায় শুভ কোন উদ্যোগ নেবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। দীর্ঘদিন গেড়ে বসা সমস্ত সামাজিক অপশাসনকে যদি একেবারে মূল থেকে উপড়ে ফেলা না যায় তাহলে সামাজিকভাবে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। মেয়েরা নির্যাতিতা হয় শুধু স্বামীর কাছ থেকেই নয় শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ-দেবর-ভাসুর সবাই সম্মিলিতভাবে কোন মেয়েকে পণের জন্য অকথ্য নির্যাতন করে সেই ভয়াবহতা প্রতিরোধ করার উপায় যে কি তা ভেবে কূল পাওয়া যায় না। যে শাশুড়ি যৌতুকের জন্য তার ছেলের বউকে নির্যাতন করে তাকেই আবার বিপাকে পড়তে হয় নিজের মেয়েকে যখন স্বামীগৃহে পাঠায়। তার মেয়েও সেখানে যৌতুকের দাবিতে নৃশংস ঘটনার বলি হয়। তাই প্রতিটি পরিবার এবং সংসার থেকেই এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গৃহের নিভৃত কোণ থেকে উদ্ভূত এই সর্বগ্রাসী পণ প্রথা মহামারীর আকারে পুরো সমাজকে আক্রান্ত করে, বিষাক্ত ছোবল মারে সর্বোপরি অসহায় মেয়েদের জীবন সর্বনাশের শেষ ধাপে এনে দাঁড় করায়। নির্যাতনের মাত্রা এমনই হয় যে এ দুর্ভোগে কোন মেয়েকে হয়ত বা শেষ অবধি পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে হয়। বেঁচে থাকলেও ক্ষত-বিক্ষত শরীর আর মন নিয়ে জীবনভর চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। এই সর্বনাশা সামাজিক অসুস্থতা থেকে নিরাময়ের যথার্থ পথ খুঁজে নিতে হবে। নারী নয় মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থান মজবুত করতে হবে। দেশ ও সমাজের একজন যোগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজের মৌলিক চাহিদা এবং অধিকারের ক্ষেত্রে সজাগ এবং সচেতন থাকতে হবে। অপরাজিতা ডেস্ক
×