ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আসন্ন রমজানে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে ॥ বাণিজ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

আসন্ন রমজানে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে ॥ বাণিজ্যমন্ত্রী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রমজান মাস সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম যাতে কেউ আর বাড়াতে না পারে এবার সেই কৌশল নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। শবে-বরাতের আগেই এবার আমদানিকৃত সকল ভোগ্যপণ্য দেশে এসে পৌঁছবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। চাহিদা ও যোগান পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রমজানে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে জোর দেয়া হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংস্থা টিসিবি’র মাধ্যমে রমজানে সারাদেশে ট্রাকসেল কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, রমজান সামনে রেখে ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। তাই রোজায় নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে। আগামী ৩০ এপ্রিল রবিবার ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ বার্তা দেয়া হবে। জানা গেছে, রমজান মাস সামনে রেখে এবার দেশে ছোলা, মসুর ও মটর ডাল এবং চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি ও সরবরাহ বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রধান পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে গত বছরের চেয়ে কিছুটা কম দামে। কিন্তু খুচরা বাজারে এসব পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরা বাজারের দায়ভার তাদের নয়। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মিলমালিক এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের দিকে নজর বাড়াতে হবে। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে কোন পণ্যের দাম বাড়বে না। যদিও পণ্যভেদে এবার আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার পাইকারি দামও কেজিপ্রতি ১ থেকে ২১ টাকা পর্যন্ত কমেছে। আমদানি সংক্রান্ত এক তথ্যে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১ জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫৬৬ টন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫৮ হাজার টন। এবারে প্রথম চার মাসে মটর ডাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার টন। এই পরিমাণ গত বছর ছিল প্রায় ৭৫ হাজার টন। এবারে ছোলা আনা হয়েছে প্রায় ১ লাখ টন, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৭৫ হাজার টন। সূত্রমতে, রোজায় বাড়তি চাহিদাসম্পন্ন চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি বেড়েছে। এস আলম, মেঘনা গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে চার জাহাজে দেড় লাখ টন অপরিশোধিত চিনি এনেছে। আর চলতি মাসে আট জাহাজে ৯২ হাজার টন ভোজ্যতেল খালাসের পর এখন আবার তিন জাহাজে এসেছে আরও ২৪ হাজার টন। এ দুটি পণ্য কারখানায় পরিশোধন করে বাজারে ছাড়া হবে। মৌলভী বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্রো জনকণ্ঠকে জানান, এবারে চিনি ও তেলের দাম গত বছরের এই সময়ের তুলনায় কম। প্রতিকেজি চিনি এখন গড়ে ৫৬-৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত বছর যা ছিল ৬৬ টাকা। এছাড়া বর্তমানে সয়াবিনের দাম কেজিপ্রতি ৭৭ টাকা ৭০ পয়সা, যা গত বছর ছিল প্রায় ৯৯ টাকা। ওই বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল থাকায় দেশেও এবারের রোজায় পণ্য দুটির দাম কম থাকবে। এদিকে, আমদানি পরিস্থিতি গত বারের চেয়ে বেশি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। কিন্তু রোজা সামনে রেখে খুচরা বাজারে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা এবং ডাল কিছুটা বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। উৎপাদন মৌসুম হওয়ার কারণে পেঁয়াজে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও রসুনের দাম বেশি। প্রথমবারের মতো গরুর মাংসের দাম নিয়ে ভোক্তাদের যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। রমজানে গরু ও খাসির মাংসের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ ভোক্তারা। তবে রোজায় অতি অত্যাবশ্যকীয় ছয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকবে সরকার। ইতোমধ্যে নতুন করে বাজার মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবি বরাবরের ন্যায় এবারও রমজানে ভর্তুকি দিয়ে পণ্যবিক্রি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। চিনি আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পণ্যটির দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে শুল্ক প্রত্যাহর করা হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ করা গেলে ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে আগামী রমজানে। এদিকে, ভোক্তাদের স্বার্থ বিচেবনায় নিয়ে গত কয়েক বছর আগে ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পণ্যগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কারণ ছাড়াই খুচরা বাজারে ইতোমধ্যে ডজনখানিক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে-সয়াবিন তেল, পামতেল, রসুন, মশুর ডাল, ছোলা, চিনি, ধনিয়া, জিরা, আদা, হলুদ, রসুন, তেজপাতা ও খাদ্য লবন। জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীদের ভোজ্যতেল, লবণ এবং চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বরাবরই বলে আসছেন, ভোক্তাবান্ধব সরকার ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করবে। আর রমজানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোন সুযোগ নেই। টিসিবির প্রস্তুতি ॥ রমজান উপলক্ষে সারা দেশের ১৭৪টি পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসাবে। যেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। রাজধানী ঢাকার ২৫টি পয়েন্টে, চট্টগ্রামের ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে ৫টি করে ট্রাক বসবে। এছাড়া জেলা শহরে দু’টি করে মোট ১৭৪টি স্থানে অস্থায়ীভাবে ট্রাক বসিয়ে স্থানীয় বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন টিসিবি’র এক কর্মকর্তা। রমজান উপলক্ষে পাচশ’ মেট্রিক টন সয়াবিল তেল, ১ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন ছোলা খোলা বাজারে ছাড়া হবে। এ প্রসঙ্গে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রি. জে. আবু সালেহ মোহাম্মদ গোলাম আম্বিয়া বলেন, আসন্ন রমজান সামনে রেখে টিসিবির বিক্রয়যোগ্য পণ্যের বিপুল পরিমাণ মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে। গত নবেম্বর থেকেই সে মজুদের কেনাকাটার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, খুব শিগগিরই সেই বাফার মজুদ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কোনো অসাধু চক্র বাজার যাতে অস্থিতিশীল করতে না পারে, এলক্ষ্যে টিসিবির মজুদ সরবরাহের মাধ্যমে স্থিতিশীল করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, রোজার জন্য আমরা ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, সয়াবিন তেল এবং চিনি সংগ্রহের জন্য টেন্ডার দিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে ২ হাজার মেট্রিক টন ছোলার জন্য কন্ট্রাক হয়ে গেছে। মসুর ডালও মজুত রয়েছে। চিনি স্থানীয় সুগার করপোরেশন থেকে সংগ্রহ করা হবে। সয়াবিন তেলের বড় অংশ ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। আরো সংগ্রহ করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এছাড়া খেজুর সংগ্রহের জন্য ইন্টারনাশন্যাল টেন্ডার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। এরফলে এখন জাতীয় পর্যায়ে টেন্ডার দিয়ে খেজুর সংগ্রহ করা হবে। চালের দাম বাড়ছে ॥ কোনো ভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না চালের মূল্য বৃদ্ধির লাগাম। প্রতিকেজি সরু চাল ৪৬-৫৬, মাঝারি মানের ৪৪-৪৬ এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকা। গত বছরের পুরো সময় দেশের মানুষকে চড়া দামেই চাল কিনে খেতে হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। মাঝে আমন ধান ওঠার সময় চালের দাম কিছুটা কমলেও আবারও বেড়েছে। এখন একেবারে চালকল বা খামার পর্যায়ে থেকে শুরু করে পাইকারি-খুচরা সব পর্যায়েই বেড়েছে চালের দাম। মিল পর্যায়ে বেড়েছে বস্তা প্রতি ৫০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে বেড়েছে ১০০ টাকা, আর খুচরা পর্যায়ে কেজি প্রতি চালের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত। এভাবে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
×