ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘দীর্ঘদিন বিনা বিচারে বন্দিদের মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে’

প্রকাশিত: ০১:৫৪, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

‘দীর্ঘদিন বিনা বিচারে বন্দিদের মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, কারাগারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষপাতি আমি নই। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে কারাগারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করার কোন দরকার নেই। তিনি বলেন, বিনা বিচারে যারা দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি রয়েছেন তাদের মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষে ‘সুপ্রীমকোর্টে আইন সহায়তা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় কাজী রিয়াজুল হক এসব কথা বলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। তিনি বলেন, বিনা বিচারে যারা দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকেন মুক্তি পাওয়ার পর তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে এনজিওগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এনজিওগুলোর সঙ্গে লিগ্যাল এইড কমিটির অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আইন সহায়তা কার্যক্রমকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এটা করা গেলেই অস্বচ্ছল ও দুস্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আরো কার্যকরভাবে আইনি সহায়তা সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। সুপ্রীমকোর্টের কনফারেন্স লাউঞ্জে গতকাল বুধবার সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি এই সভার আয়োজন করে। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, সুপ্রীমকোর্টের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। প্রতিদিনই লিগ্যাল এইড অফিসে ২০/২৫ জন অস্বচ্ছল ও দুস্থ বিচারপ্রার্থীরা ভিড় করেন। আমরা তাদের বক্তব্য শুনে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমাদের চিঠির প্রেক্ষিতে কারাকর্তৃপক্ষ ৪৬২ জন বিনা বিচারে কারাগারে আটক বন্দির তথ্য পাঠায় লিগ্যাল এইড অফিসে। সেখান থেকে যাচাই করে ৫৮ জনকে পাওয়া যায় যারা দশ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাকিদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তিনি বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত অনেক সময় যথাযথভাবে জেল আপিল দাখিল করেন না। ফলে ওই ত্রটিপূর্ণ জেল আপিল নিষ্পত্তি না হয়ে পড়ে থাকে। এছাড়া বিশেষ আইনের মামলায় নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপীল দাখিল করতে হয়। অনেকেই এই নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপিল না করায় তা খারিজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে এনজিওগুলোর যে প্যারা লিগ্যাল টিম রয়েছে তাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আইন সহায়তা সেবা প্রাপ্তি নাগরিকের অধিকার। এটা সরকারের বদান্যতা নয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ যে তার নাগরিকদের সমস্ত অধিকারগুলো দেবে, আর এটাই মানবাধিকার। তিনি বলেন, কক্স্রবাজার জেলখানা পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পেলঅম সেখানে বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৫৩০ জন। কিন্তু রাখা হয়েছে ১৮শত জনকে। এদের মধ্যে ৩০০ বন্দি রয়েছেন যারা বিভিন্ন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। সেখানকার জেলা প্রশাসক ও জেল কর্তৃপক্ষ বলল আমাদের কারাগারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। কিন্তু আমি এ ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পক্ষপাতি নই। কারন যিনি বিনা বিচরে কারাগারে আটক রয়েছেন ওই ব্যক্তি তো রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে সেখানে থাকতে চান না। তার তো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু তাকে কারাগারে রেখে তার অধিকারগুলো খর্ব করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের পয়সাও খরচ হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে হাইকোর্ট থেকে বিনা বিচারের আটকদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু আদেশ দেয়া হয়েছে। এসব আদেশে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে দীর্ঘদিন কাউকে বিনা বিচারে কারাগারে থাকতে হবে না। কাজী রিয়াজুল হক বলেন, একটি ডাকাতির মামলায় বাবুল নামে এক ব্যক্তি বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাগারে আটক ছিলো। কিন্তু ওই মামলায় সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর। কিন্তু তাকে ২৫ বছর জেলে থাকতে হয়েছে। পরে তিনি মামলা থেকে খালাস পান। কিন্তু এই ২৫ বছর তাকে কে ফিরিয়ে দেবে? তিনি বলেন, সামনে জাতীয় বাজেট আসছে। এনজিওগুলো থেকে বলা হচ্ছে তারা প্রজেক্ট নির্ভর কাজ করে থাকে। যখন প্রজেক্ট শেষ হয়ে যায় তখন কাজ শেষ না হলেও আর অর্থ পাওয়া যায় না। তখন সরকারের উচিত এই প্রজেক্টগুলোকে টেনে নেয়া। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, অস্বচ্ছল ও দুস্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইন সহায়তা সেবা প্রদান সরকার বা এনজিওগুলো কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য একটি কমন প্লাটফর্ম দরকার যার মাধ্যমে এই আইন সহায়তা কার্যক্রমকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, কোন ভুলের কারনেই একজন বন্দিকে বিনা বিচারের ১৫ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। এই ভুলের মাশুল কে দেবে? নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে এনজিওগুলোর ভূমিকা রয়েছে এ ধরনের ব্যক্তিকে পুনর্বাসন করতে। এজন্য একটি ফান্ড গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, এনজিওগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকার মূখ্য ভূমিকা পালন না করলে সেটি কখনো টেকসই হবে না। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যাদের পক্ষে আইনি সহায়তা দেওয়ার কেউ নেই তাদের মানবাধিকার রক্ষার জন্যই কাজ করে লিগ্যাল এই অফিস। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিফা হাফিজ, ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থার প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ, এলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা ইউনিটের প্রধান সাজেদা ফারিসা কবীর, জিআইজেড এর হেড অফ প্রোগ্রাম প্রমিতা সেনগুপ্ত প্রমুখ বক্তব্য দেন।
×