ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবনী আক্তার সান

অনন্য উচ্চতায় ইউনুস খান

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

অনন্য উচ্চতায় ইউনুস খান

প্রথম পাকিস্তানী ক্রিকেটার হিসেবে ১০ হাজার টেস্ট রানের মালিক হয়েছেন ইউনুস খান। জ্যামাইকায় ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত ৫৮ রানের পথে স্মরণীয় এই কীর্তি গড়েন তিনি। তৃতীয় দিন টি-ব্রেকের পর রোস্টন চেজকে সুইপ করে মাইলফলকে পা রাখেন ইউনুস। পেসার শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের বলে ক্রেইগ ব্রেথওয়েটের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে ১৩৮ বলে ইউনুসের অবদান ৫৮। ৫ চার ও ছক্কা ১টি। অনন্য কীর্তি গড়ার মুহূর্তটা উদ্যাপন করেন স্মিতহাস্যে, ব্যাট উঁচিয়ে, সতীর্থদের হালকা করতালির মধ্যে। কিংস্টোনের স্যাবাইনা পার্কে তার এই অনন্য অর্জনে উল্লাস করার জন্য খুব বেশি দর্শকের উপস্থিতি ছিল না। এ পর্যন্ত ১০ হাজার রানের এলিট ক্লাবে যত ক্রিকেটার পা রেখেছেন, তাদের মধ্যে ইউনুসের প্রবেশটাই হলো সবচেয়ে অনাড়ম্বরভাবে, কম দর্শকের সামনে। ক্যারিয়ারের ১৭ বছরে (খেলার সময়কাল), ১১৬ টেস্টের ২০৮তম ইনিংসে ১০ হাজার রানে পা রাখেন ৩৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজটি খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন, বিদায়বেলায় ইউনুসের জন্য এটি অনন্য অর্জন। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবুধাবিতে জাভেদ মিয়াদাঁদের ৮,৮৩২ পেরিয়েই টেস্টে পাকিস্তানীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছিলেন। টেস্ট ইতিহাসে এ নিয়ে ১৩ ক্রিকেটার দশ হাজারী ক্লাবে নাম লেখালেন। মাইলফলকে পৌঁছানোর দ্রুততায় ইউনুসের অবস্থান ষষ্ঠÑ ১১৬ টেস্টের ২১২তম ইনিংসে। ১৯৮৭ সালে টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ হাজার রান ছুঁয়েছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার। ১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার এ্যালান বোর্ডার দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এই অনন্য অর্জনে নাম লেখান। এরপর একে একে স্টিভ ওয়াহ, ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, রিকি পন্টিং, শিবনারায়ণ চন্দরপল, জ্যাক ক্যালিস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা ও এ্যালিস্টার কুক। তবে একটা জায়গায় আর সবাইকে ছাড়িয়ে ইউনুস। গড়েছেন সবচেয়ে বেশি বয়সে ১০ হাজার রানের সংগ্রহের রেকর্ড। পরশু তার বয়স ছিল ৩৯ বছর ১৪৩ দিন। তালিকায় শিবনারায়ণ চন্দরপল দ্বিতীয় স্থানে (৩৭ বছর ২৫১ দিন)। পরের তিন জন সুনীল গাভাস্কার, স্টিভ ওয়াহ ও এ্যালান বোর্ডার। ‘আরও তিন বছর আগেই ক্রিকেট ছাড়তে চেয়েছিলাম। এরপর জাভেদ ভাইকে ছাড়িয়ে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের মালিক হলাম। এবার প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে পেলাম দশ হাজার রান, এই ক-বছর যা আমাকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছে। পাকিস্তানকে ম্যাচ ও সিরিজটা জেতাতে পারলে আরও ভাল লাগবে’Ñ প্রতিক্রিয়ায় বলেন ইউনুস। আর দুই বছর আগে মিয়াদাঁদকে টপকে পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট রানের মালিক হওয়ার পর ইউনুস বলেছিলেন, ‘টপকে যাওয়া মানে গ্রেটনেস অতিক্রম নয়। আমি কখনই মিয়াদাঁদের সমকক্ষ নই।’ বিনয়ের উদহারণ গড়ে সেটিই ফিরিয়ে দেন মিয়াদাঁদ। মিয়াদাঁদের বক্তব্য, ‘আমি খুবই খুশি যে এমন একজনের হাতে আমার রেকর্ড ভেঙ্গেছে, যে কিনা সব সময় দেশ এবং দলের জন্য খেলে থাকে। ইউনুস অত্যন্ত পরিশ্রমী ক্রিকেটার। প্রতিভা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে সৎ ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটা মনগড়া বক্তব্য নয়, কাছে থেকে দেখেছি। ও আমার কোচিংয়ে খেলেছে, সব সময় তাঁকে একজন ভাল ছাত্র হিসেবেই জেনেছি। পাকিস্তান ক্রিকেটে ইউনুসের অবদান অনস্বীকার্য। ওর সৌভাগ্য কামনা করছি। এখনও ব্যাট হাতে খিদেটা প্রচ- রকমের। আশা করছি রেকর্ড গড়ার পরও সে থেমে থাকবে না। গত ১৫ বছর যেভাবে খেলে এসেছে নিজেকে সেভাবেই চালিয়ে নেবে।’ ২০০৩-২০০৭ পর্যন্ত অধিনায়ক হিসেবে ইউনুসকে কাছ থেকে দেখেছেন ইনজামাম-উল হক। উত্তরসুরি সম্পর্কে সাবেক অধিনায়কের মূল্যায়ন, ‘যখন ও দলে এল আমি ওর মধ্যে কেবল প্রতিভাই দেখিনি বরং একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যাটসম্যানকেও দেখেছি। ইউনুসের বড় গুণ দলের প্রয়োজনে ঠিকই বড় ইনিংস খেলে দেয়।’ বর্তমান অধিনায়ক মিসবাহ-উল হক বলেন, ‘ড্রেসিং রুমে ওর মতো একজন গ্রেট ব্যাটসম্যানকে পেয়ে আমরা সত্যি গর্বিত। ১৯৭৬-১৯৯৩ পর্যন্ত ১২৪ টেস্টে ৮,৮৩২ রান করে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রানের মালিক ছিলেন মিয়াদাঁদ। পরের তিনটি স্থানে ইনজামাম উল হক (৮,৮২৯), মোহাম্মদ ইউসুফ (৭,৫৩০) ও সেলিম মালিক (৫৭৬৮)। জ্যামাইকা টেস্টের দ্বিতীয় দিনই ইউনুস বলেছেন নিশ্চিত অবসর নিচ্ছেন তিনি। এদিক-ওদিক থেকে অনেক গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে আমি নাকি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করছিÑ এর কোন সত্যতা নেই। আমার অবসরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে প্রতিটি টেস্টের প্রতিটি ইনিংসেও সেঞ্চুরি করি, তাহলেও এই সিদ্ধান্ত বদলাবে না। স্থানীয় জিও টিভিতে ভিডিওটি প্রচারিত হয়। অথচ টেস্ট শুরুর আগের দিন সিএ’র সাইটে প্রকাশিত সাক্ষাতকারে ইউনুসের বক্তব্য ছিল এমনÑ ‘এটা ঠিক যে আমরা একসঙ্গে অবসরে গেলে দল বিপাকে পড়বে। এ নিয়ে বেশ চিন্তা করেছি। সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার ভার দল ও বোর্ডের ওপর। তারা যদি মনে করে আমাকে প্রয়োজন, তাহলে হয়ত আরও কিছুদিন চালিয়ে যেতে পারি। দেশের মানুষ যদি আমাকে দেখতে চায়, আমি নিজেও যদি ব্যাট হাতে পাকিস্তানের হয়ে অবদান রাখতে পারি, তাহলে কেন অবসর নেব?’ ভিডিওতে এমন ভাষ্যকে গুঞ্জন ও ভুল বলে উল্লেখ করেন ইউনুস। অবসরের আগাম ঘোষণা দেয়া অধিনায়ক মিসবাহও চেয়েছিলেন ইউনুস আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে যাক। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান দল তাকে শুধু একজন ব্যাটসম্যান হিসেবেই হারাবে না, একজন উপদেষ্টা হিসেবেও মিস করবে। সে অন্যদের রোল মডেল। আর তার জায়গা পূরণ করাটাও বেশ কঠিন। তার আরও ১-২ বছর টেস্ট ক্রিকেট খেলে যাওয়া উচিত।’ ইউনুসের ভিডিও বার্তায় সব জল্পনার অবসান হয়। ৪৩ ছোঁয়া মিসবাহর সঙ্গেই উইন্ডিজ সফরেই শেষ হচ্ছে ৩৯ বছর বয়সী তুখোড় এই ব্যাটসম্যানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।
×