ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাজ্জাদ কাদির

হেফাজতে ইসলাম ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

হেফাজতে ইসলাম ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন

২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন চট্টগ্রামের প্রায় একশ’টি কওমী মাদ্রাসার শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত হয়। হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ইযহারুল ইসলাম এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। সংগঠনটি সৃষ্টির পর থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং আশপাশের এলাকায় সীমিত আকারে এর কার্যক্রম চালাত। দেশের মানুষ কোনভাবেই এটিকে সেইভাবে জানত না। কিন্তু যে মুহূর্তে মানবতাবিরোধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরু হয়েছিল, ঠিক তার পরেই এই সংগঠনটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। যে সংগঠনটির কার্যকলাপ অতীতে কখনো চোখে পড়ার মত ছিল না, সে সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলন করে শাহবাগ আন্দোলনে জড়িতদের গণহারে নাস্তিক, মুরতাদ বলে রায় দেয় এবং চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের কোন সমাবেশ করতে দেয়া হবে না বলে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দেয়। যে কারণে এটিকে প্রথম দিকে জামায়াতেরই একটি ভিন্নরূপ মনে করা হতো। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে এই হেফাজত তাদের একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুরো ঢাকা শহরে এক ভয়াবহ তা-বলীলা চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে। এই তা-বলীলাকে সমর্থন জানিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া হেফাজতের নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে দলীয় নেতা-কর্র্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে এই হেফাজতকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার আশা ব্যক্ত করেন। ভেতরে ভেতরে স্বপ্নও বুনতে থাকেন যে, এই হেফাজতকে দিয়েই সরকার পতন ঘটাবেন। এই পক্ষটি একান্তভাবে চাইছিল যে, হেফাজত শাপলা চত্বরে দিনের পর দিন অবস্থান করুক এবং একটি পর্যায়ে হেফাজতের ঘাড়ে ভর করে ফায়দা লোটা হবে। এই পরিকল্পনার সবই আগেই গোয়েন্দা রিপোর্টে সরকারের হাতে চলে আসে। সেই অনুযায়ী সরকার এই সমাবেশকে উচ্ছেদ করে। এগুলো সবই পুরনো খবর। ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার হেফাজত নেতা শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক, বৈঠকে হাইকোর্টের সামনে ভাস্কর্য অপসারণে সহমত পোষণ, কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে-ই-হাদিসকে স্নাতকোত্তর স্তরের মর্যাদা দেয়ার ঘোষণা এবং এ ব্যাপারে দুদিন পরে ১৩ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি। হঠাৎ করে কী এমন ঘটনা ঘটে গেল যে, দেশের সুশীল সমাজসহ আওয়ামী লীগ এবং শরিক দলগুলো এমনকি প্রধানমন্ত্রীও যে সংগঠনের কার্যকলাপে চরম বিরক্ত, সমালোচনায় মুখর ছিলেন, সেই সংগঠনটিই গণভবনে গিয়ে সরকারকে আস্থায় নিয়ে তাদের কয়েকটি দাবি-দাওয়া আদায়ে সক্ষম হল। ঘটনা যাই ঘটুক, আমরা সাধারণ মানুষ সাদা চোখে বিশ্বাস করতে চাই বা অনুমান করতে চাই যে, সরকারবিরোধী পক্ষ বর্তমান সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতকে নিয়ে নানা সঙ্কটের কারণে জামায়াতকে মাইনাস করে হেফাজতের ওপর ভর করে দেশকে সম্প্রতি চরম অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। আর ২০১৩ সালের ৫ মে’র মতো সেই পরিকল্পনা সরকারের শীর্ষ মহলে অতি দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে গেছে। সেই কারণেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে হেফাজতকে কাছে টেনেছেন। তাদের কয়েকটি দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রীর এই হেফাজতকে কাছে টেনে নেওয়াটি দেশের আপামর জনসাধারণ, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, তারা মোটেই ভালভাবে নেননি। তাদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এখন আওয়ামী লীগ এবং শরিক দলগুলোর উচিত হবে জনসাধারণকে আস্থায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দেশের অরাজক পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্যই যদি হেফাজতকে কাছে টানা হয়, তাহলে এটিকে সমর্থন করা যেতেই পারে। বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থের নিকট কখনও কখনও আত্মসমর্পণ করা মনে হয় অন্যায় নয়। এই জিনিসটি বোঝাতে হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে। কারণ ভোটের বাক্সে এই মানুষগুলোই আওয়ামী লীগের আপন এবং কাছের। এই মানুষগুলোকে বাদ দিয়ে হিসাব কষলে হিসাব ভুল হয়ে যাবে। বাংলা নববর্ষের ঠিক তিন দিন আগে হেফাজতের সঙ্গে বৈঠক, নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকারের বিধি নিষেধ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হুমকি সব মিলিয়ে এবার ১ বৈশাখে সারাদেশের অয়োজন ছিল বিগত কয়েক বছরের তুলনায় খানিকটা সংক্ষিপ্ত। সামগ্রিকভাবে সরকারের ভাবনা কীÑ দেশের মানুষ জানতে চায়। এই সরকারই আন্দোলনের মাঠে এক সময়ের দোর্দ- প্রতাপশালী জামায়াতকে কঠোর হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছে। আর জামায়াত সরাসরি ভোটের রাজনীতির মাঠের একটি রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে হেফাজতকে আমরা এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের চেহারায় দেখতে পাইনি। ভবিষ্যতে রাজনীতির মাঠে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সরকার পক্ষ হতে এক সময়ের ব্যাপক বিতর্কিত ও সমালোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম এখন কেন আবার সরকারের কাছাকাছি আসছে, সেটি দেশবাসীর নিকট খোলাসা করতে হবে। একটি বিরাট জনগোষ্ঠী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। আর গত কয়েক বছরে এই স্বপ্ন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বর্তমান সরকার। যার কারণে বিগত কয়েক বছরে সব ধরনের বঙালী উৎসব উদযাপিত হয়েছে এক অন্যরকম উৎসাহ-উদ্দীপনায়। হঠাৎ এ বছর কী হলো? যেটি কিনা ভোটের বছরের আগের বছর। এই দেশ তো কোন একক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নয়। এই দেশে যুগ যুগ ধরে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্য সকল গোষ্ঠী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসব উদযাপন করতে অভ্যস্ত। কেন হঠাৎ বিধিনিষেধ? কেন ১ বৈশাখসহ সকল প্রকার বাঙালী উৎসব উদযাপন স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে দেয়া হবে না? দেশের আপামর জনসাধারণকে এগুলো পরিষ্কার করতে হবে। দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা দল আওয়ামী লীগ। আবার সেই আওয়ামী লীগই কী স্বপ্ন ভঙ্গ করার পথে হাঁটছে? না, দেশের মানুষ সেটি মোটেই বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা রাজনৈতিক দল। এরকম একটি রাজনৈতিক দল কোনভাবেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ভঙ্গ করতে পারে না। কারণ আওয়ামী লীগ স্বপ্ন ভঙ্গ করলে দেশের মানুষের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। মানুষ চরম হতাশ হয়ে পড়বে। কাজেই মেহেরবানি করে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন যে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটবে না। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী
×