ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হোসেন আদনান

প্রতিক্রিয়া ॥ প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

প্রতিক্রিয়া ॥ প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

গত ১৬ মার্চ বৃহস্পতিবার ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’ স্বদেশ রায়ের কলামটি পড়লাম। লেখাতে স্বদেশ রায় আপনাকে সৌভাগ্যের বরকন্যা হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাচ্ছেন। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের যা কিছু উন্নয়ন ও মূল্যবোধের উজ্জীবন তার সবই অর্জন সম্ভব হয়েছে আপনি ও আপনার দল ক্ষমতায় থাকায়। কত যুক্তিসিদ্ধ ও চিত্তহারী ভাষায় স্বদেশ রায় বলেছেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে, অনেক রক্ত, অনেক সামরিক ব্যটনের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আজ সেই সৌভাগ্য অর্জন করতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার চার দশক পরে বাংলাদেশ এমন একজন নেতা পেয়েছে, যার অবস্থান এখন সবার উপরে। তাকে ছাড়া দেশের উন্নয়ন, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন চিন্তা করা যায় না।’ বাঙালী ১৯৭১-এর পূর্বে কখনও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। হাজার বছর ধরে বহু বিজাতীয় শক্তির অধীনে থেকে বহু শাসন-শোষণ-নির্যাতন ভোগ করে, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেক বিকৃত মন-মানসিকতার অধিকারী একটি জাতিকে নেতৃত্ব দেয়া বড়ই কঠিন কাজ। আপনি সেই কঠিন কাজ সম্পাদনে রত। স্বদেশ রায় আপনাকে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরু, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ, থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমি বলব, আপনি তাদেরও উর্ধে। একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাঙালী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে-প্রেরণায় সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করল। যে ভাষার জন্য বাঙালী বুকেরা রক্ত দিল, আপনি তাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন। আপনি ‘ইনডেমনিটি’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলালেন। যারা ১৯৭১-এ রাজাকার আলবদর আলশামস্্ হিসেবে নৃশংসতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, তাদেরও বিচারের আওতায় এনে মানবতাবিরোধী মানুষরূপী এসব পশুর যথাযথ দ-প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন। অতি সম্প্রতি ২৫ মার্চের কালরাত্রিকে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করেছেন। আশা করি, একদিন এই ‘গণহত্যা দিবস’-এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলবে। ক্ষমতায় এসে আপনি পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেছেন, গঙ্গার পানি চুক্তি করেছেন, ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছেন, সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করেছেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। আমরা ভুলিনি, পদ্মা সেতু ছাড়াও অন্যান্য মেগা প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছেন আপনি। আপনার চলার পথ এখনও অনেক দুস্তর। স্বাধীনতাবিরোধী হায়েনার দল এখনও মাঠে-ঘাটে, অফিস-আদালতে সর্বত্র সক্রিয়। তারা আওয়ামী লীগে ঢুকে আওয়ামী লীগকে ছিবড়া বানানো, আওয়ামী লীগের বদনাম রটানো, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ভূমিকা পালন- সবই পূর্ণ মাত্রায় করে যাচ্ছে। বিশ্বে জঙ্গী উত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের জানা। সম্প্রতি হয়ত জঙ্গী তৎপরতা একটু বেড়েছে। এছাড়া গত নির্বাচনের আগে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ মারা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়ার কথাও স্মর্তব্য। এ ব্যাপারে আপনি ও আপনার দল সজাগ আছেন তো! ২০১৯ সাল হবে এ দেশের ভাগ্যাকাশে এক ক্রান্তিকাল। ওই বছরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে তার স্বরূপে আনতে আপনি কী ভাবছেনÑ ১. আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীদের যে কোন মূল্যে চিহ্নিত করে তাদের ঝেঁটিয়ে দূর করতে হবে। ২. যারা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের লেবাস পরিহিত হলেও মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগার নয়, তাদের ‘সাইজ’ করুন। ৩. আপনার দলের নেতাদের বিশেষত কয়েকজন মন্ত্রীর মুখের লাগাম টেনে ধরুন। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও দুয়েকজন ছাড়া অন্যরা বিরোধী দলের বা বিরুদ্ধমতের সমালোচনা করবে না। এতে ‘ফস্্কানি’ কথাই বেশি বের হয়। ৪. বিরুদ্ধ মতকে ধরাশায়ী করার জন্য আপনি দলীয়ভাবে একটি ‘প্রচার সেল’ খুলুন। (এটা আমাদের অনেক দিনের দাবি।) বিরোধী দলের পরিকল্পিত প্রচার-প্রপাগান্ডার দাঁতভাঙ্গা জবাব আমরা আশা করি। ৫. আপনার দলে আরও কিছু মেধাবী, চৌকস রাজনীতিকের সমাবেশ ঘটান, যাদের মেধা-মনন হবে উচ্চ মার্গের। যারা হবে নীতি ও আদর্শে উদ্দীপ্ত। যারা থাকবে দেশের প্রতি ‘কমিটেড’। দলে শুদ্ধি অভিযান চালান। সম্প্রতি পাকিস্তান জুনায়েদ আহম্মদকে দিয়ে একটি বই লিখিয়েছে শুনেছি। বইয়ের নাম ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’। যতটুকু জেনেছি বইটি আগাগোড়া মিথ্যায় ভরপুর। সত্যকে অস্বীকার করার নামান্তর। কিন্তু পাকিরা তা করছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। পত্রিকান্তরে খবর যে, সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টস চার্চের ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ পালনে বাধা দিয়েছে পাকি শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা। ১৯৭১-এ বাংলাদেশে কী ঘটেছিল আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তা জানি। কিন্তু পাকিরা বলছে, তা নাকি মিথ্যাচার। ১৯৭১-এ এ অঞ্চলে কী ঘটেছিল তার সাক্ষী শুধু আমরা না, সারা পৃথিবী। পাকিরা যতই চেঁচামেচি করুক সত্য দেদীপ্যমানই থাকবে। মাননীয় জননেত্রী, ‘ধান ভানতে’ বোধ হয় ‘শিবের গীত’ শুরু করেছি। আমার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কিন্তু কেবল ওগুলো নয়। নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকেও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ১. যারা দখল-দূষণে লিপ্ত থেকে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত তাদের ব্যাপারে সংসদে ‘বিল’ আনতে পারেন কিনা দেখুন। দখল-দূষণে লিপ্তদের মদদদাতাদের ব্যাপারেও আপনি পদক্ষেপ নিন। ২. জমিজমা সংক্রান্ত মান্ধাতার আমলের আইন পাল্টিয়ে তা আধুনিকায়ন করার ব্যবস্থা করুন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করুন। ব্যাপারটি আপনাকেই দেখতে হবে। বিলম্ব হলেও ব্যাপারটা শুরু তো করতে হবে। ৩. পুলিশ ও আমলাদের দুর্নীতি যে কোন মূল্যে বন্ধ করুন। ৪. আরেকটি বিষয়ে সবিনয়ে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করছি। সেটা হচ্ছে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং হত্যা। যৌতুকের জন্য নারী হত্যা, ইভটিজিং-এর কথা না-ই বা বললাম। এসব বন্ধ করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দরকার। দুর্নীতি দমনের ন্যায় এসব অনাচার বন্ধ করতে হলে আপনাকে মনে হয় পৃথক একটি বাহিনী তৈরি করতে হবে। তারা হবে আগাগোড়া সৎ, দক্ষ, নিবেদিত, কর্মনিষ্ঠ ইত্যাদি গুণের আধার। দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব বাহিনীর সদস্যদের হতে হবে উচ্চ শিক্ষিত এবং সুশিক্ষিতও। ৫. অসহায় মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের জন্য কিছু একটা করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অনেকেই তো পরপারে চলে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের শেষ জীবনটা যাতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপত্তায় কাটে সে ব্যবস্থা করুন। আমাদের আশা যে, গোটা জাতি আপনার ডাকে এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। ৬. সঠিক মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রমের কী হলো। যাচাই-বাছাই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল না তো! প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল করুন। ৭. আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আপনাকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হতে হবে। আপনার বিরুদ্ধ শক্তিও ২০১৯ সালের নির্বাচনে মরণ কামড় দিতে চেষ্টা করবে। সুতরাং সাধু সাবধান। এখনও নির্বাচনের দেরি আছে। আপনার দল জোট ক্ষমতায় আছে। ভোটারদের মন জয় করতে হলে এর মধ্যে বাজারের দিকে নিবিড় দৃষ্টি দিন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ন্ত্রণে রাখুন, চাঁদাবাজি বন্ধ করুন, দলের কোন্দল বন্ধ করুনÑইত্যাদি পদক্ষেপ যথাযথভাবে নিন। ৮. বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম অবিচ্ছিন্ন। সুতরাং যারা বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে না, তাঁর অবদানকে স্বীকার করে না, তাকে জাতির পিতা মানে না, শুধু শেখ মুজিব বলে, তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। কারণ এরা চিহ্নিত। একাত্তরের ব্যাপারে, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে, আওয়ামী লীগের ব্যাপারে এদের এলার্জি আছে। এদের ব্যাপারে জাতীয় সংসদে আপনি ত্বরিত বিল আনুন। এদের হীনম্মন্যতা ও নিচু মনমানসিকতা আর মেনে নেয়া যায় না। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, স্বাধীনতাবিরোধীরা আপনার ও আপনার দলের বা আপনার সরকারের সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে রাখবে সবকিছুর উর্ধে। গোটা দুনিয়ায় তা হচ্ছে। এখানে কেন হবে না? এটা তো রাজনীতি নয়, এটা নোংরামি। আসলে এরা দেশের সংবিধান মানে না। দেশের স্থিতিশীলতা এরা চায় না। দেশের প্রতি এদের সামান্য মায়া-মমতা-প্রেম নেই। তা না হলে দেশে এত জঙ্গী উত্থান হয় কিভাবে? আর আপনাকে নিকেশ করার জন্য তারা এত উদ্বাহু কেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আওয়ামী লীগের প্রধান, সরকারেরও প্রধান। আর এদেশের মানুষের বেশি আশা-আকাক্সক্ষাও বরাবর আওয়ামী লীগের কাছেই বেশি, তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। তাই তো আপনি বাঙালীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সুফল আপনি ও আপনার দল পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাবে। জনকল্যাণমুখী আর কোন দল তো বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে আমরা দেখছি না। মাননীয় নেত্রী, স্বদেশ রায়ের আরেকটি চমৎকার বক্তব্য দিয়েই এই লেখার সমাপ্তি টানছি : ‘এক হাতে চীন, আমেরিকা, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থের সঙ্গে লড়ে নিজের স্বার্থ আদায় করা; অন্য হাতে পাকিস্তানী নেতৃত্বে চলা গোটা বিশ্বের ইসলামিক মৌলবাদের ছোবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করাÑ এ যে কোন বিশ্বযুদ্ধের থেকে অনেক বড় যুদ্ধ।’ এ যুদ্ধে তো আপনাকে জয়ী হতেই হবে। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক, ফেনী
×