রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন,হবিগঞ্জ থেকে ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন ভাবে কাজ করুক, তা প্রশাসন কোন দিনই চায়নি। সব সরকারের আমলেই বিচার বিভাগের উপর বিমাতা সূলভ আচরন চলছে। অথচ বিচার বিভাগই প্রশাসনের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। কিন্তু আমলাতন্ত্র সব সময়ই বিচার বিভাগকে প্রতিদ্বন্ধি মনে করে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখন নিজ বিভাগে নিরাপত্তা পাননা, তখন তারা বিচার বিভাগের কাছেই আসেন। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগই তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, শুধু টাকা থাকলেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রশাসনের যারা উচ্চপর্যায়ে আছেন, তাদের পরিচালনা করেন কিছু আমলা, কিছু লোক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সত্য জিনিসটি তাদের কর্মক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয় না। যার প্রেক্ষিতে তারা মনে করে বিচার বিভাগ তাদের প্রতিপক্ষ। এটি তাদের ভুল ধারণা।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজ করে না। বিচার বিভাগ সবসময় একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। তাদের যত কিছুতে ত্রুটি থাকে তা নিয়ে বিচার বিভাগের কাছেই আসতে হয়। আমরা তাদের বিচার করি। তারা নিরাপত্তা পায় না, প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা পায় না, নিশ্চয়তা পায় না চাকরি সংক্রান্ত, প্রমোশন সংক্রান্ত, তখনই এই বিচার বিভাগ তাদের নিশ্চয়তা দেয়।
পুরাতন মামলা নিষ্পত্তি করার উপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারকের অভাবে মামলার জট সৃষ্টি হয়। এজন্য নতুন বিচারক নিয়োগসহ নিম্ন আদালতের বিচারকদেরকে ভারতের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এখন যত দুর্যোগ আসুক তা বাইরের সাহায্য ছাড়াই মোকাবেলা করা হচ্ছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুল মোছাব্বিরের সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক জমশেদ মিয়া ও নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মো. লুৎফুর রহমানের পরিচালনায় এতে বক্তৃতা করেন, জেলা ও দায়রা জজ মো. আতাবুল্লাহ, অ্যাডভোকেট চৌধুরী আব্দুল হাই, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত, নূরুল আমিন, অফিল উদ্দিন, সিরাজুল হক চৌধুরী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রশাসনের আজকে যারা ক্ষমতায় আছেন। সব সময় তিনি থাকবেন না। তিনিও একদিন অবসরে যাবেন। তখন সাধারণ নাগরিক হিসেবে থাকবেন। তাদের আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন তারাও এদেশে থাকছেন। তাদের তো সমস্যা হতে পারে। যদি বিচার বিভাগকে শক্তিশালি করা হয়, তবে তাদের সাময়িক ক্ষমতার পরে যে অনিশ্চয়তার মাঝে পড়বেন তখন কিন্তু বিচার বিভাগই তাদের নিশ্চতা দেবে। এটি তারা যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন ভুলে যান। যার প্রেক্ষিতে তারা মনে করেন বিচার বিভাগ আমাদের সবগুলো নিয়ে ফেললো, খেয়ে ফেললো। এটি তাদের ভুল ধারণা।
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা যারা আইনজীবী তারা এটি তুলে ধরবেন। জনমত গঠন করবেন। তাহলে এ ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, অনেক দেশ আছে যারা অনেক ধনী। যাদের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি টাকা আছে। কিন্তু তাদের উন্নত জাতি হিসেবে ধরা হয় না। শুধু টাকা থাকলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নের জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আজ মঙ্গলবার দুপুরে তার সম্মানে দেয়া হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির এক বিশাল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও সম্বর্ধিত ব্যক্তিত্বের বক্তব্যে এই কথা বলেন। জেলা বার লাইব্রেরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক এমপি এডভোকেট আব্দুল মোছাব্বির। এডভোকেট লুৎফুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সভায় অন্যান্যের মাঝে বক্তব্য রাখেন, বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আতাবুল্লাহ, প্রাক্তন এমপি এডভোকেট আব্দুল হাই, প্রবীন আইনজীবি ও ভাষা সৈনিক সৈয়দ আফরোজ বখত, জেলা আইজীবি সমিতির সভাপতি এডভোকেট আফিল উদ্দিন প্রমুখ।
এসময় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমারকে ক্রেস্ট প্রদানের মাধ্যমে সম্বর্ধিত করে সংশ্লিস্ট আইনজীবি সমিতি। তার আগে গতকাল সোমবার দুপুরে দুদিনের সফরে প্রধান বিচারপতি হবিগঞ্জে এসে পৌছালে জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম ওজেলা ও দায়রা জজ মো. আতাবুল্লাহসহ গণমান্য ব্যক্তিবর্গ সার্কিট হাউজে তাকে স্বাগত জানান। এদিন রাতে বিচার বিভাগ, জেলা প্রশাসন, আদালত সংশ্লিস্ট গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের পদবীধারী আইনজীবিগণ,সিভিল সার্জন, গণপূর্ত বিভাগ সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা জেলা সার্কিট হাউজ সভা কক্ষে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আতাবুল্লাহ’র সভাপতিত্বে এবং জেলা প্রশাসক সাবিনা আলমের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিচার প্রার্থী সাধারন মানুষের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ‘আদালতকে আরও গতিশীল করার করনীয় শীর্ষক’ এক এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। নবনির্মিত জুডিশিয়াল ভবনও পরিদর্শন করেন তিনি।