হাসান নাসির ॥ ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’- এই স্লোগানে এগিয়ে চলা চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন তার নিজেরই সঙ্গে। প্রতিবছর নিজকে নিজে ছাড়িয়ে যাওয়া বন্দর ক্রমেই উন্নীত হচ্ছে নতুন উচ্চতায়। দেশের আমদানি-রফতানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সক্ষমতা। নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর শুধু দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বারই নয়, প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিবেশী দেশসমূহকে সেবা দিতে। সে লক্ষ্যে চলমান রয়েছে বিদ্যমান অবকাঠামোর সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। গৌরবের ১২৯ বছর পেরিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পদার্পণ ঘটছে ১৩০ বছরে। মঙ্গলবার উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হবে ১৩০তম বন্দর দিবস, যে দিনটির জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বন্দর ব্যবহারকারীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কন্টেনারযোগে প্রবেশ করে ১৯৭৭ সালে। সে বছরই বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আমদানিকারকগণ প্রথম প্রত্যক্ষ করলেন কন্টেনারে পণ্য আসা। মাত্র ৬টি কন্টেনারের মাধ্যমে শুরু হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে হ্যান্ডলিং প্রায় ২২ লাখ টিইইউএস কন্টেনারে উন্নীত হয়েছে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম বন্দরের বিশেষ এই দিবসকে ঘিরে এবারের আয়োজন ব্যতিক্রমধর্মী। কর্তৃপক্ষ এবারই প্রথম আয়োজন করতে যাচ্ছে ‘পোর্ট এক্সপো।’ উদ্দেশ্য, বন্দরকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। এ অঞ্চলে অনেকটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও মার্কেটিংকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। কারণ, দেশে নতুন নতুন বন্দর গড়ে ওঠার পাশাপাশি প্রতিবেশী মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর ডেভেলপ করা হয়েছে ভারতের সহায়তায়। চট্টগ্রাম বন্দরও সক্ষম ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি অঙ্গরাজ্য এবং সার্কভুক্ত দেশ নেপাল ও ভুটানকে সেবা দিতে। পোর্ট এক্সপোতে অংশগ্রহণ করবে বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের শতাধিক প্রতিষ্ঠান, যা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৭ এবং ২৮ এপ্রিল। তবে এর আগে ২৫ এপ্রিল বন্দর দিবসে শুরু হয়ে যাবে উৎসবের আয়োজন। এদিন অপরূপ রূপে সাজবে বন্দর। সকাল ৯টায় জাতীয় পতাকা এবং বন্দর পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বন্দর দিবসে অনুষ্ঠানের সূচনা হবে। সেদিন বন্দর এলাকায় অবস্থানরত সকল জাহাজ থেকে একযোগে বাজানো হবে সাইরেন। বরাবরের মতো এবারও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য থাকছে ভোজের আয়োজন। এছাড়াও রয়েছে বন্দরের মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা, শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন এবং জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে পরিবেশন করবেন খ্যাতিমান শিল্পীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, দেশের আমদানি রফতানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্দরের সক্ষমতার উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটাতে নানা প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ এবং আরএমজি সেক্টরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের কন্টেনার আমদানির ৯৮ শতাংশ এবং কার্গো আমদানির ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবাহিত হয়ে থাকে। দেশে আরও বন্দর গড়ে উঠলেও চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব থাকবে সর্বাধিক। আর এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এর সক্ষমতা দ্বিগুণে উন্নীত করা প্রয়োজন বলে মনে করছে সরকার।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিপ টু শোর গ্যান্টিক্রেন সংযোজনের মাধ্যমে কন্টেনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে ১০ হাজার হারে কন্টেনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলে ২০১৯ সালে হ্যান্ডলিং ক্ষমতা উন্নীত হবে ২৩ লাখ ৮০ হাজার টিইইউএস কন্টেনারে। কিন্তু তখন আমদানি যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে তাতে অন্তত ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৬৬ হাজার টিইইউএস কন্টেনার। ২০২২ সালে সেই ঘাটতি বেড়ে উন্নীত হবে ১০ লাখ ৫২ হাজার টিইইউএস কন্টেনারে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- যে হারে বাড়ছে তাতে বন্দরকেও উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে এর আগে কর্তৃপক্ষ দ্রুতগতিতে নির্মাণ করতে চায় কর্ণফুলী কন্টেনার টার্মিনাল (কেসিটি) এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি)।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এ্যান্ড প্লানিং) মোঃ জাফর আলম জানান, হালিশহরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ করা এগিয়ে চলেছে। এর জন্য প্রায় সকল ছাড়পত্রই সংগৃহীত হয়েছে। বিশাল এ জায়গার পুরোটাই খাস জমি। সেখানে কোন জনবসতি নেই। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ অর্থ ব্যয় করতে হবে না। বে-টার্মিনালকে আগামীর বন্দর হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, দেশের চাহিদা বিবেচনায় ২০২৩ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
বন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন জেগে ওঠা এগার কিলোমিটার দীর্ঘ চরে গড়ে উঠবে বে-টার্মিনাল। এর অবস্থান উপকূল থেকে ৮০০ মিটার দূরে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই চ্যানেলে টার্মিনাল নির্মিত হলে একসঙ্গে ৩০-৩৫টি জাহাজ বার্থিং নিতে পারবে। বর্তমানে বিদ্যমান বন্দরে জাহাজ ভিড়তে পারে সর্বোচ্চ ১৯টি। বে-টার্মিনাল চ্যানেলে ১২ থেকে ১৩ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। বর্তমান বন্দরে ভেড়ানো যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। চট্টগ্রাম এখন ভিড়তে পারে ১ হাজার ৯০০ টিইইউএস কন্টেনারবাহী জাহাজ। আর বে-টামিনালে ৫ হাজার টিইইউএস কন্টেনারের জাহাজ পর্যন্ত ভেড়ানো যাবে। এ টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে।
এদিকে, বন্দর দিবসকে সামনে রেখে এখন থেকেই বন্দর এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুরু হয়েছে বন্দরকে কেন্দ্র করে শহরের পুরো একটি অংশকে রং-বেরঙের কাপড় ও পতাকায় শোভিত করার প্রক্রিয়া। ব্যস্ত সময় কাটছে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ১৩০তম বন্দর দিবসের অনুষ্ঠান সফল করতেই তাদের এ ব্যস্ততা। উৎসবে নতুন সংযোজন দুদিনব্যাপী ‘পোর্ট এক্সপো’ অনুষ্ঠিত হবে বন্দর কার শেডে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এ্যান্ড প্ল্যানিং) জাফর আলম জানান, এ অঞ্চলে মনোপলি থাকায় আমরা মার্কেটিংয়ের বিষয়টি এতদিন বিবেচনায় আনিনি। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে নতুন বন্দর গড়ে উঠছে এবং আমদানি-রফতানি বাড়ছে তাতে মার্কেটিংয়ের বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত বলে মনে করছি। সে কারণেই এবারের বন্দর দিবসের আয়োজন হতে যাচ্ছে ভিন্ন আমেজে।