ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

অভিমত ॥ ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’

অধিকারের প্রশ্নে মানুষ লড়েছে যুগ যুগ ধরে। বিভিন্ন সময়ে ছিনিয়ে এনেছে নিজের অধিকারও। এনেছে জাতীয় মুক্তি, এনেছে স্বাধীনতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনের ইতিহাসও অধিকার রক্ষার। মাতৃভাষার অধিকার আদায় করতে প্রথম রক্ত ঝরেছে বায়ান্নতে। রাজনৈতিক অধিকার আর অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন ঊনসত্তরের রাজপথ রক্তেরঞ্জিত করেছে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-’বজ্রকণ্ঠের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালী মুক্ত করেছে পরাধীনতা। পলাশীর আম্রকাননে নিভে যাওয়া সূর্য আবার সতেজে উদয় হলো বাংলার আকাশে। আমরা পেলাম মানচিত্র। দেশ পরিচালনার জন্য পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫(ক) অনুচ্ছেদে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে- ২৭ অনুচ্ছেদে। ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণমানুষের জন্য ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন বার বার। ন্যায় বিচারের অনুপস্থিতি একটি জাতির নৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন করে। শুধু আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণে বা দারিদ্র্যের কারণে যেন কোন মানুষ ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয়, এ উপলব্ধি থেকেই ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তন করেন ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান বিধিমালা।’ বিনামূল্যে আইনী সেবার হাত প্রসারিত হয় সুপ্রীমকোর্ট থেকে উপজেলা আদালত পর্যায়ে। লিগ্যাল এইড কমিটি গঠিত হয়- জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে। ‘গরিব মানুষের মামলার ভার নেবে সরকার’ সেøাগানে আদালতে অসচ্ছল মানুষের মামলার ব্যয়ভার সরকার নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। এর পরের কার্যক্রম যুগান্তকারী। বিনামূল্যে আইনগত সহায়তার সঙ্গে যুক্ত করা হলো ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ইডআর)। অর্থাৎ আদালতে মামলা হয়ে জন্ম নেয়ার আগেই পক্ষগণের বিরোধ আপোসের মাধ্যমে মিটিয়ে দেয়ার জন্য নিয়োগ করা হলো লিগ্যাল এইড অফিসার। সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার এ কর্মকর্তার কাজ শুধু দরিদ্র মানুষের আইনী সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা আর বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি করা। বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের সফলতার জন্য তিনটি বিষয় জড়িত। প্রথমত বিচারপ্রার্থী, যাদের জন্য এ আয়োজন, তাদের স্বত্ব:স্ফূর্ত অংশ গ্রহণ। দ্বিতীয়ত প্যানেল আইনজীবী, যাদের ভূমিকা আদালতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত সত্য বিচারক, যিনি নিজেকে পক্ষপ্রীতি, ভীতি, লোভ, আর সংশয়ের উর্ধে রেখে ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করবেন। সাধারণ মানুষের কাছে বিনামূল্যের কোন কিছু সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা অনেক দিনের। একান্ত নিরুপায় না হলে কেউ সহজে সরকারী হাসপাতালে যেতে চান না। ঠিক তেমনি প্রচারণা যতই হোক, সরকারী আইনী সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তেমন আগ্রহী নয়। যাদের জন্য আইনী সহায়তা, তাদের আকৃষ্ট করতে শুধু প্রচারণা যথেষ্ট নয়। আদালতে এসে বিচারপ্রার্থী অসচ্ছল কোন মানুষ যেন বিফল মনোরথ না হয়। ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, বিষয়টা আগে নিশ্চিত করতে হবে। লিগ্যাল এইডের প্রতিটি মামলায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তদারকি ও জবাবদিহিতা থাকা জরুরী। আইনী সেবার প্রকৃতি হতে হবে দ্রুত ও উন্নত। আর এ জন্য বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও বিচার আদালতের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা বাড়াতে হবে। সফলভাবে শুনানি সম্পন্ন বা সফল নিষ্পত্তি এবং মামলা প্রমাণের জন্য যে যে অনুষঙ্গ প্রয়োজন, সব পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ বা পরিধি আরও বাড়াতে হবে। (যেমন-‘ডিএনএ’ পরীক্ষা, স্থানীয় তদন্ত, হস্তলিপি ও অঙ্গুলাঙ্ক পরীক্ষা, রেজিস্ট্রিযুক্ত দলিল বা পর্চার সার্টিফাইড কপি উপস্থাপন ইত্যাদি)। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- সেবাধর্মী মানসিকতার বিকাশ। সবার ওপরে দেশের স্বার্থকে, দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। যে মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য লিগ্যাল এইড কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তাকে কোনভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। ছোটখাটো যে ত্রুটিগুলো রয়েছে, তা নিরসন করে এ কর্মসূচী শতভাগ সফল করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যে, লিগ্যাল এইড কার্যক্রম কোন মাকাল ফল নয়। বিনামূল্যে আইনী সহায়তা কার্যক্রম ও বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রমের সফলতা কামনা করি। লেখক : আইনজীবী ও সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার কাউন্সিল
×