ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে নবাগত দেশের করণীয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে নবাগত দেশের করণীয়

ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল এলাকায় অবস্থিত ফ্লামঁভিল্লা পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে গত ৯ ফেব্রুয়ারি এক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। তাৎক্ষণিক সতর্কতা হিসেবে কর্তৃপক্ষ দুটি চুল্লির একটি বন্ধ করে দেয়। উল্লেখ্য, ১ হাজার তিন শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক চুল্লি দুটি যথাক্রমে ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সাল থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করে আসছে। যাহোক, দুর্ঘটনার বিবরণে প্রকাশ ওই বিদ্যুত কেন্দ্রের একটি ভেন্টিলেটরে বিস্ফোরণের কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। তাই এটি পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে কারিগরি ত্রুটিজনিত দুর্ঘটনা হলেও পারমাণবিক দুর্ঘটনা নয়। তারপরও কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হয়েছে এতে বিকিরণ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই। আসলে এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে যে, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে দুর্ঘটনা হলেই সেখান থেকে বিকিরণ ছড়িয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ, ইকোলজি, নদ-নদী, খাল-বিল, মাটিÑসবকিছু আক্রান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা পারমাণবিক দুর্ঘটনা কি না, তা যাচাই বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য না নিয়েই গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়ে যায়। যেমন মার্চ, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচির পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে সুনামির কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনাও এ-রকম নির্বিচার প্রচার পেয়েছিল। এমনকি প্রচার করা হয়েছিল যে, রেডিয়েশন নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। বস্তুত পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে সংঘটিত ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে সংবাদ পরিবেশনায় দায়িত্বশীলতা ও জানাশোনা জরুরী। এর ব্যত্যয়ে জনগণের নিকট ভুলবার্তা পৌঁছে। বিভ্রান্তি পাকাপোক্ত হয়। এর জেরে কোন দেশের পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার দাবি ওঠে। এমনকি ওই ধরনের জনদাবি অনেক সময় মানতেও হয়, যেমন জার্মানি। আয়োজন করতে হয় গণভোটের, যেমন সুইজারল্যান্ড। জনদাবির মুখে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজও বন্ধ রাখার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন ভারতের তামিলনাড়–র কুদানকুলাম। তাই বিভ্রান্তি আর হুজুগে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং ওই একই কারণে নতুন পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। বিশেষ করে, পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে নবাগত দেশের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি আরও প্রকট। আবার জনগণের এই বিভ্রান্তি ও হুজুগের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের যোজসাজশে গভীর ষড়যন্ত্র। তখন তা মোকাবেলা সত্যিই চ্যালেঞ্জের হয়ে পড়ে। এই ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য অন্য আরেক কারণে উদ্বেগের। আর তা হলো, আপাতদৃষ্টিতে ষড়যন্ত্রকারীরা স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী নয়, বরং দেশপ্রেমিক সেজে গণতন্ত্রের কথা বলছে, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য জনগণকে জানানোর তাগিদ দিচ্ছে। অনেকটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ার ঢং-এ (শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালে অনেককে বলতে শোনা যেত আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।) আমরাও চাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হোক, কিন্তু...। আসলে এই ‘কিন্তু’র মধ্যেই যত রহস্য এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের এজেন্ডা। পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত উৎপাদন বিরোধিতা, নতুন করে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন ও পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে নবাগত দেশের সামনে বিদ্যুত উৎপাদনে নন-নিউক্লিয়ার অবস্থায় থাকার নানা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হাজির করার যে গতানুগতিক অনুশীলন রয়েছে, বাংলাদেশের রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন বিরোধিতা অন্তত সেই আঙ্গিকের নয়। বিশেষ কারণ ও বাস্তবতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাÑ সবই উচ্চতর প্রযুক্তিগত বিষয়। কিন্তু রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। কোন দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বই কেবল পারে অনেক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিকভাবে এত বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে। সন্ত্রাসবাদের বীজতলা পাকিস্তানে যেখানে তিনটি রি-এ্যাক্টর থেকে ছয় শ’ নব্বই মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করছে, বাংলাদেশ সেখানে জাতীয় গ্রিডে দুই হাজার চার শ’ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুত যুক্ত করার বাস্তবতা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এটি কি বাংলাদেশের চিরশত্রু পাকিস্তানের জন্য গাত্রদাহের কারণ নয়? আর ওই গাত্রদাহ নিয়ে পাকিস্তান কোন ষড়যন্ত্র করবে না এবং তা বাস্তবায়নে লোকাল এজেন্ড নিয়োগ করবে না, তা কি হয়? এ তো গেল বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতা তথা নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে জনমানসের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভীতি দূরীকরণে রূপপুর প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেন, তারা জনসচেতনতায় ও জনমানসের নেতিবাচক ধারণা দূরীকরণে কি ব্যবস্থাপত্র নিয়ে এগুবেন। সেখানে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের বিষয় আশয় আছে কি-না কিংবা একজন পেশাদার কর্মকর্তাকে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শইবা ধারণ করতে হবে কেন? কিন্তু এরপরও কথা আছে। যেমন নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের বিশেষ মিডিয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ যে নিছক সাংবাদিকতা নয় কিংবা এই সাংবাদিকতার পেছনে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থাকতে পারে, তা কি সাধারণ পেশাজীবীরা বুঝতে সক্ষম? কিংবা তাদের এ-বিষয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থা আছে? বস্তুত নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের বিশেষ মিডিয়ার প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশ এবং গোলটেবিল বৈঠকসহ নানামুখী আয়োজনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগ ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন’ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগণের সামনে দেশ, পরিবেশ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। আসলে সচেতন ও সুকৌশলে অদৃশ্য হাতের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বিরোধী প্রপাগা-া চালানো হচ্ছে। এর বিপরীতে বা নেতিবাচক প্রচারণার জবাবে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে ইতিবাচক প্রচারের কৌশল কি হবে, এই প্রচারে সরকারের সাফল্যের অন্তর্ভুক্তি কিভাবে ঘটতে পারে তা নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু কৌশল নির্ধারণে বিলম্ব সরকারের অতি সাহসী উদ্যোগ ‘বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের যুগে পদার্পণকে’ জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকেই পাকাপোক্ত করার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এ বিষয়টি হেলাফেলার নয়, নয় জোড়াতালির। বরং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের শীর্ষ মহলকে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী তথা ইতিবাচক প্রচারের বিষয়টি নিয়ে ভাবা জরুরী। লেখক : বিজ্ঞান গবেষক
×