ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শখের মেলা

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ২২ এপ্রিল ২০১৭

শখের মেলা

বাঙালীর চিরন্তন উৎসব মেলা। বলা যায় প্রাণের উৎসব। দূর অতীতে মেলার আবেদনই ছিল গ্রামে। নদীর তীরে, কোন বটতলায়, কোথাও পাকুড়তলায়, কোথাও কোন হাটের ধারে। হাটের কাছাকাছির মেলাকে বলা হতো হাটখোলার মেলা। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে মেলার আয়োজন ছিল বাধ্যতামূলক। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ শুরু হবে অথচ মেলা হবে না তা গ্রামের মানুষের কল্পনাতেও আসেনি। নিকট অতীতে শহরে কোন মেলা বসেনি। মেলার মতো যা হতো তা প্রদর্শনী। ইংরেজীতে একজিবিশন। কৃষি শিল্প শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যতিক্রমী কোন কিছু প্রদর্শন করা হতো বলেই নাম ছিল একজিবিশন। গ্রামের লোকের ভাষায় এই প্রদর্শনী পরিচিতি পায় ‘শখের মেলা’ নামে। গ্রামীন মেলা ও শখের মেলার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। গ্রামের মেলার স্থান কোন নিধুয়া পাথার। একটা সময় পাথারের মধ্যে বা কোন প্রান্তে বট-পাকুড় গাছ থাকতই। কখনও খেয়াঘাটে মেলা বসত। নদীর প্রতিটি খেয়াঘাটে ছিল বটগাছ। প্রকৃতিতে আপনা আপনি গজিয়ে ওঠা এই বটগাছ রোপণ করতে হয়নি। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কথায়- বটগাছে পাখি বসে বীজ খাবার পর উড়ে যাওয়ার পথে কোন স্থানে বিষ্ঠা ফেললে সেখানে গজে ওঠে বটবৃক্ষ। কোন পরিচর্যা ছাড়াই বেড়ে ওঠে বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের তলায় বসে মেলা। নিধুয়া পাথারে যখন রোদের তাপে দর্শনার্থীদের হাঁসফাঁস অবস্থা তখনই মেলার লোকজন বটতলায় বসে শরীর জুড়িয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে। বৈশাখী মেলার সময় থাকে তীব্র রোদ। এমন খরতাপের মধ্যেই লোকজন মেলায় যায়। উৎসবের আমেজ খরতাপকেও হার মানায়। কখনও আকাশের কোনে জমে ওঠা কালো মেঘ ঝড়-বৃষ্টি এনে দেয়। মেলায় দোকানিরা আশ্রয় নেয় বটতলায়। তখন বটতলার চারদিকে জনারণ্য। একদিকে ঝড়ো হাওয়া, সঙ্গে বৃষ্টি মেঘের গর্জনে মেলা প্রকৃতি থেকেই আলাদা রূপ পেয়ে যায়। কখনও বৈশাখী মেলার আনন্দ বয়ে আনে ঝড়-বৃষ্টি। বৈশাখী মেলায় গ্রামীণ জীবনের বড় অনুষঙ্গ অতিথি নিমন্ত্রণ। বিশেষ করে মেয়ে-জামাইয়ের নিমন্ত্রণ বাধ্যতামূলক। বছরজুড়ে জামাই শ্বশুরবাড়ি না এলেও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠের মেলায় ‘আমদুধের’ নিমন্ত্রণ থাকতেই হবে। বাঙালীর জীবনে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘জামাই বেজার’। অর্থাৎ জামাই গোস্বা করেছে বা অভিমান করেছে। জামাই যাতে বেজার না হয় তার পালা শুরু হয় বৈশাখী মেলা থেকেই। বৈশাখী মেলা উপলক্ষ হয়ে রেশ চলে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় অবধি। যে কারণে গ্রামীণ জীবনে বৈশাখী মেলার গুরুত্ব আজও অনেক বেশি। একটা সময়ে দেশের প্রতিটি গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তির লগ্ন থেকেই বৈশাখী মেলার আয়োজনের স্থান দেখা শুরু হয়েছে। বৈশাখী মেলা মানেই বটতলা হাটখোলা থাকতেই হবে। খেয়াঘাটের কাছে বাস করে ঢুলি। ঢুলিরা ঢাক বাজিয়ে জানান দেয়, এসে গেল বৈশাখ। ঢাকের এই বাদ্য চৈত্রের শেষে শুরু হয়ে চলেছে বৈশাখের কয়েকটি দিন। কখনও মাসজুড়ে। বৈশাখী মেলায় ঢাকের বাদ্য থাকতেই হবে। ঢুলিদের রোজগার বেশি হয় বৈশাখ মাসে। বৈশাখী মেলাকে ঘিরে যত অনুষ্ঠান তার প্রতিটিতেই ঢাকের বাজনা থাকা চাই। বৈশাখী মেলাকে ঘিরে মেয়ে জামাই শ্বশুরবাড়িতে এলেও ঢাকি বাদ্য বাজিয়ে স্বাগত জানায়। বাদ্যের তালে স্বজনরা বরণ করে নেয় মেয়ে-জামাইকে। তারপর মেলায় কে কীভাবে যাবে কী কিনবে তার আয়োজন করা হয়। গ্রামের বৈশাখী মেলাগুলোর দোকান বসাতে বাঁশের কোন ঘর তুলতে হয় না। পাথারের মধ্যে পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। ময়রারা মিষ্টি বানায় পাথারের মধ্যে মাটি খুঁড়ে চুলা জ্বালিয়ে। দর্শনার্থীরা মিষ্টি বানানো দেখে। চুরি ফিতা ক্লিপ আলতা কাঁকই (চিরুনি) মাটির মালা, পুঁতির মালা, কানের দুল, নাকফুলসহ নানা কিছু আসে বৈশাখী মেলায়। বটতলার বৈশাখী মেলা আবর্তিত হয় বাঙালী সংস্কৃতির কালের প্রবাহে...। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×