ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামাল ইনু

সত্য গেছে নির্বাসনে

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২২ এপ্রিল ২০১৭

সত্য গেছে নির্বাসনে

সত্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কিন্তু প্রচারেই প্রসারের যুগে রাজনীতিতে সত্যের চিত্রটা একটু ভিন্ন। তা আরেকবার প্রমাণিত হলো নির্বাচনপূর্ব বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি টুইটকে ঘিরে। গত ২০ মার্চ তিনি মুখোমুখি হন সে টুইট নিয়ে হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির শুনানিতে। যা শেষ পর্যন্ত তার জন্য ডেকে এনেছে এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। আর এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি সুযোগ পেয়েছেন প্রেসিডেন্টকে প্রকাশ্যে এক হাত নেয়ার। নির্বাচনপূর্ব প্রচারাভিযানে ডোনাল্ড ট্রাম্প তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে অভিযুক্ত করেছিলেন ট্রাম্প টাওয়ারে ওয়্যার ট্যাপিংয়ের বিষয়টি যদি আইনগত পথে হয়ে থাকে তবে এফবিআইর তা জানার কথা। আর বেআইনীভাবে এমন কিছু হয়ে থাকলে বিষয়টি কেবল ঐতিহাসিক কেলেঙ্কারি বলেই বিবেচিত হবে না আসবে এফবিআইর তদন্তের আওতায়। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি কোমি ও তার ব্যুরোর তদন্তের আওতায় এসেছে এবং তদন্ত শেষে তিনি মিডিয়ার সামনে বলতে বাধ্য হয়েছেন, তদন্তে আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটের বক্তব্যকে সমর্থন করে। কোমি আরও বলেন, আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করেছি। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি উত্তর সেই একই। কোমির বক্তব্য সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট এবং সরাসরি রাষ্ট্রের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা কোমি প্রেসিডেন্টকে প্রকারান্তরে মিথ্যাবাদী বলেছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ তদন্ত কর্মকর্তা যাকে মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করেছেন অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিন্তু ঘটনার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নির্বিকার। নৈতিকতাবোধ তো দূর; রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হিসেবে মিথ্যাবাদিতার সামান্য লজ্জাও তাকে স্পর্শ করেনি। উল্টো তিনি নিজের সাফাই গাইছেন পূর্বের মতোই বুক চিতিয়ে। তার উত্তর খুব সহজ, আমি নিজস্ব ধারণা তাড়িত একজন মানুষ আর আমার ধারণা সত্যি হয়ে থাকে। ওভাল অফিস থেকে দেয়া এক টেলিফোন সাক্ষাতকারে তিনি আরও দাবি করেন যে, আমি এখনও বিশ্বাস করি আমার অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হবে। আমার কাছে ওয়্যার ট্যাপিংয়ের পক্ষে প্রমাণ আছে। ট্রাম্প যে মিথ্যা বলছেন তা পরিষ্কার। গত ২০ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ওয়্যারটাপ করে পাওয়া তথ্য অন্য একটি তদন্তে ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের বিষয়ে ব্যবহার করা হলেও ওয়্যার ট্যাপিংয়ের লক্ষ্য কখনই ট্রাম্প ছিলেন না এবং এর সঙ্গে বারাক ওবামা কোনভাবেই সম্পৃক্ত নন। হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান ডেভিন নুনেস সম্প্রতি বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন একটু ঘুরিয়ে। তিনি বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখে তার মনে হয়েছে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও তার উপদেষ্টারা অন্তত নজরদারিতে ছিলেন তবে সেটি আইনী কার্যক্রমেরই অংশ। কিন্তু নুনেস নিজেও এ দাবি করেননি ‘ওয়্যার ট্যাপিংয়ের সঙ্গে ওবামা জড়িত ছিলেন। আর ট্রাম্প নুনেসের বক্তব্য থেকে খুঁজে নিয়েছেন তার সুযোগ। তার ভাষায় নুনেস যা বলেছেন তাতেই প্রমাণ হয় আমার অভিযোগ সত্য! তিনি আরও বলেন, তার টুইটের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? ট্রাম্পের ভাষায় বারাক ওবামাকে জড়িয়ে তার ‘ওয়্যার ট্যাপ’ অভিযোগ বুঝতে হলে তার পূর্বানুমানগুলো বিবেচনায় নিতে হবে যা পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন, খুব কম লোকই আমার বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমি জিতব এবং আমি জিতেছি। আমি বলেছিলাম ব্রিটেন বেরিয়ে যাবে ইইউ থেকে। সবাই হামলে পড়েছিল আমার ওপর কিন্তু সেটাই ঘটেছে। ব্রাসেলসের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে তার ভবিষ্যদ্বাণীও সঠিক হয়েছে। শেষে তিনি যোগ করেন, ‘আমি এমন একজন মানুষ যে জানে সবকিছু কিভাবে চলে।’ তিনি এমন এক বিষয়েও বাহবা নিতে চান যে, ঘটনাটি তার বর্ণিত সময়ে ঘটেনি। ইউরোপে অধিবাসী নিয়ে তিনি বলেছিলেন আজ রাতে দেখুন সুইডেনে কি হচ্ছে। কিছুই ঘটেনি সে রাতে তার কথামতো। অন্য এক প্রসঙ্গে দু’দিন পর স্টকহোমে যে দাঙ্গা হয় সেটিকেই ট্রাম্প তার নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণীর উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। ট্রাম্প মনে করেন সত্য সময়ে পূর্ণতা পাবে। নির্বাচনপূর্বে ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসীর বেআইনী ভোট প্রদানের বিষয়ে তার যে অভিযোগ তাও একদিন সত্য প্রমাণ হবে। এ কথা বলেই তিনি সুর পাল্টান। বলেন, ‘আমি যখন অভিযোগ করি আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছিলাম ভোটারদের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি ঠিক ছিল না।’ সার্বিক বিশ্লেষণে এটি পরিষ্কার ট্রাম্প এমন এক প্রেসিডেন্ট সত্য এবং মিথ্যার মাঝে ফাঁরাক রাখেন সামান্যই। আর বেকায়দা দেখলে পালানোর পথ খোলা রাখেন। প্রচারাভিযানের সময় তিনি টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজের পিতাকে নিয়ে মিথ্যা কাল্পনিক অভিযোগ আনেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি সে জন্য ন্যূনতম ক্ষমা চাইতেও অস্বীকার করেন; তার ভাষায়, ‘আমি তো কেবল সংবাদপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি।’ শুরু থেকেই তিনি ঝামেলায় জড়িয়েছেন মিডিয়া থেকে শুরু করে বিচারক পর্যন্ত। আর পূর্বে ওবামার যে সাফল্য তিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন ফুৎকারে তার ব্যাখ্যা এখন দিচ্ছেন এভাবেÑ ‘অতীতে বিষয়টি তেমনি ছিল কিন্তু এই সাফল্য এখন বাস্তবতা।’ এতকিছুর পরও ট্রাম্পের দাবি তিনি সৎ। জাতীয় রাজনীতিতে ট্রাম্পের প্রবেশ ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্ম আফ্রিকায় এমন এক মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে। সেটি ছিল কেবল শুরু। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের শুরুতেই তিনি মেক্সিকোকে অভিযুক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী পাচারের। আর প্যারিস হামলার পর দাবি করেন, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর তিনি টেলিভিশনে দেখেছেন হাজার হাজার মানুষ নিউ জার্সিতে আনন্দ করছে (যার সপক্ষে অদ্যাবধি কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি)। আর বাস্তবতা হচ্ছে ট্রাম্প ভালই জানেন, ‘সত্য ভাল, কিন্তু মিথ্যা তার চেয়ে বেশি কার্যকর। তার মিথ্যাচার থেমে নেই বিজয়ের পরও। পপুলার ভোটে বিজয়ের বিষয়ে তার দাবি ছিল ‘আপনি যদি অবৈধ ভোটারদের ভোট বাদ দেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমি পপুলার ভোটে বিজয়ী।’ তার এই টুইটটি রিটুইট করা হয়েছে ৫৩ হাজার বার। তিনটি অঙ্গ রাষ্ট্রে ভোট জালিয়াতির তার প্রমাণহীন অভিযোগটি রিটুইট হয়েছে ৩১ হাজার বার। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত ট্রাম্প যে, ২৯৮টি টুইট করেছেন তার ১৫টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আর এই মিথ্যা রিটুইট হয়েছে গড়ে ২৮ হাজার ৫৫০ বার, আর মিথ্যা টুইটগুলো প্রচার মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছে ৩১ বার করে, যা অন্যগুলোর দ্বিগুণ। ট্রাম্পের প্রাক্তন উপদেষ্টা রজার স্টোন বলেন, ‘ট্রাম্প ভাল করেই জানেন কি করে ইস্যু তৈরি করতে হয় আর আলোচনার মোড় ঘোরাতে তিনি ওস্তাদ। তিনি কেবল সে বিষয়েই কথা বলেন যা তিনি বলতে চান।’ সব মিলিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে তার এই মিথ্যাচারের রাজনীতি কি রাষ্ট্র পরিচালনায় কাজে আসবে? তার বিশ্বাসযোগ্যতার এই সঙ্কট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যাবে? বিশ্ব রাজনীতিতে মিত্ররা তাকে কতটুকু আস্থায় নিতে পারবেন? এ বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তোলা প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘এদেশে ওদের কথা শোনার কেউ নেই। এটি একটি ভুয়া প্রচার মাধ্যম।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশবাসী আমাকে বিশ্বাস করে।’ জনাব ট্রাম্প ভাবতেই পারেন কারণ তিনি প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তার সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের মানদ- যখন প্রমাণ নয় তার নিজস্ব অনুভূতি আর বিশ্বাস তখন এ কথা বলাই যায় সত্যের নতুন সংজ্ঞার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে মার্কিন রাজনীতি। যে যুগ শেষে মার্কিন রাজনীতির কোন কট্টর সমালোচক বলতেই পারেন, ‘সত্য গেছে নির্বাসনে।’ সূত্র : টাইমস্্
×