ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

‘ভাবিয়া করিও কাজ প্রতিজ্ঞা যখন’

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২২ এপ্রিল ২০১৭

‘ভাবিয়া করিও কাজ প্রতিজ্ঞা যখন’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন যে, ভিক্ষুকের কোন আত্মমর্যাদা থাকে না। কথাটি প্রথমে বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পরিচালনাকালে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশপ্রেম ও পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য দেশের মানুষকে পরিশ্রমী হতে হবে, কাজ করতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে। অন্যথায় ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে থাকলে আমরা কখনই দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারব না। ফলে মর্যাদাহীনভাবে আমাদের টিকে থাকতে হবে আর সেভাবে টিকে থাকা মানে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনা। এত ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে তাই ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্পকালীন শাসনামলে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের বিশ্বসভায় স্থান করে দেবার। কিন্তু দেশী-বিদেশী চক্রান্ত আর ঘাতকের সঙ্গীন তাঁকে সে আশা পূরণ করতে দেয়নি। পরবর্তীকালে সামরিক ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট উড়ে এসে জুড়ে বসা শাসকরা দেশের উন্নয়নের নামে সেই আইয়ুবী আমলের মতোই ঢক্কা নিনাদ বাজিয়ে বেড়িয়েছে। দেশের দর্শন ও চেতনাগত ক্ষেত্রে নানান বিভেদ, অস্পষ্টতা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে জাতির মধ্যকার অমিত বিক্রম এবং তেজকে এতকাল দমিয়ে রেখেছে তারা। নিছক গোষ্ঠী তোষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এক লুটেরা শ্রেণী তৈরি করে দেশের মর্যাদাকেই ভূলুণ্ঠিত হবার পথ প্রশস্ত করে গেছে ঐ গোষ্ঠী নিজেদের ও তাদের প্রভুদের মনোতুষ্টির জন্য। তাই বিদেশের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভর আর বিদেশী ঋণের জন্য তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকা ঐসব শাসক দেশের মর্যাদাকে সবচেয়ে গৌণ বিষয় হিসেবে মেনে নিয়েছিল। বিদেশী ঋণের সিংহভাগকে তারা নিজেদের বিত্ত-বৈভব গড়ার কাজে ব্যবহার করেছে রাজনীতির নামে, জনকল্যাণের নামে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা যেহেতু কেবল একটি পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয় ছিল না, সেহেতু যে ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নকল্পে পঁচাত্তরে সেই নৃশংস হত্যাকা-টি ঘটানো হয়েছিল সেই নীলনক্সার আওতায় ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতাকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে বজায় রাখার ব্যবস্থা চালু রেখেছিল ঐ গণবিরোধী শাসকরা। বিদেশনির্ভরতা স্বাভাবিকভাবে মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণীর লোকের জন্য নগদ নারায়ণ প্রাপ্তির (অর্থ-বিত্ত অর্থে) বন্দোবস্ত করলেও সার্বিকভাবে দেশের মানুষ স্বনির্ভর হওয়ার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিল ক্রমান্বয়ে। আর এটিই ছিল মতলবী ঋণদাতা বা সাহায্যদাতাদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষকে ঐ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল রেখে আর দেশটিকে নতজানু করে তাদের নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ফায়দা লোটার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা জারি রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তাই দেশের মানুষের দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন চিরতরে দূর করার মতো কোন বাস্তবসম্মত উদ্যোগ-আয়োজন আমাদের সেসব সরকারকে কদাপি গ্রহণ করতে দেখা যায়। বরং উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট বা ঐ জাতীয় কংক্রিটাশ্রয়ী উন্নয়নকে কুমিরের একটি ছানাকেই বারবার প্রদর্শনের মতো করে জাতির সামনে মেলে ধরা হতো। অর্থাৎ কিনা দেশে রাস্তা-ঘাট, চোখ ধাঁধানো ভবন ইত্যাদিকেই উন্নয়ন হিসেবে চালিয়ে দেবার প্রবণতা আর এসবের মাধ্যমে লুটেরা শ্রেণীর ক্ষমতাকে সুসংহত করা হচ্ছিল মাত্র! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে আর সেই একই পাকিস্তানী কায়দায় প্রতিবেশী ও আমাদের সবচেয়ে পরম সুহৃদ ভারতের সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব জারি রেখে তারা যে শাসনধারা রচনা করেছিল তাতে সার্বিক মানবকল্যাণ, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, দেশবাসীর আর্থিক উন্নয়ন তথা গোটা দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো ছিল সবচেয়ে উপেক্ষিত। চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের সেই দুর্ভেদ্য দেয়াল ভাঙতে পঁচাত্তর পরবর্তীকালে দেশের গণমানুষকে একাত্তর পরবর্তী সময়ের মতোই পুনরায় সংগ্রাম-সাধনায় ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে। আর এবার এই সংগ্রামের অন্যতম বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন। এই চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশল গড়ে তোলা ও তার পরিচর্যার বিষয়টি ছিল অপরিহার্য। কিন্তু শাসকবর্গ ইতোমধ্যে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই চেতনাবিরোধী তথা পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারায় আচ্ছন্ন ও ভারত বিদ্বেষী একটি শিখ-ী শ্রেণীকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হওয়ায় তাদের পরাভূত করে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা কোনক্রমেই সহজসাধ্য বিষয় ছিল না। দেশ অভ্যন্তরে এই দেশবিরোধী শ্রেণীর শক্ত ভিত গড়ে তুলতে দেশী-বিদেশী কুচক্রী মহল পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে সার্বক্ষণিক সচেষ্ট থেকেছে। এমন কোন অন্যায় বা অবৈধ পথ নেই যে পথ কিনা ওরা এতদুদ্দেশ্যে অবলম্বন করেনি। হত্যাকা-, গুম, ধ্বংস, উৎখাত, বিতাড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন ইত্যাকার সব ধরনেরই হীন ব্যবস্থা ওরা নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের নীতি ও আদর্শকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে। সুতরাং, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটি নতুনভাবে, নতুন আঙ্গিকে যেন পুনরায় ফিরে এলো এই দেশে। ভূ-লুণ্ঠিত চেতনা পুনরুদ্ধারকল্পে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিকে যারপরনাই নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে এই যাত্রায়ও। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই কথাতেই আবার ফিরে যাওয়া যাক। তারা দেশকে ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতা থেকে বের করে এনে আত্মনির্ভরশীল বা স্বনির্ভর ও মর্যাদাবান জাতিতে রূপান্তরের যে কথা বলেন বা বলেছেন তার দর্শনগত দিকটি অনুধাবন করতে না পারলে এর গভীর তাৎপর্য বোধগম্য হবে না। তাই প্রথমেই বোঝা দরকার যে, আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাবান বলতে তারা কি বোঝাতে চাইছেন। মজার ব্যাপার হলো এই একই কথা কিন্তু জিয়া-এরশাদ-খালেদার মুখেও বহুবার শুনেছি আমরা; কিন্তু এদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কথার বিস্তর ফারাক যে রয়েছে তা কি আমরা বুঝতে পারি? জিয়া-এরশাদ-খালেদা গংয়ের কথা নিছক লিপ সার্ভিস ছাড়া কিছু নয়। কেননা, তাদের উদ্দেশ্য যা তা চরিতার্থ বা বাস্তবায়ন করতে হলে ঐ জাতীয় লিপ সার্ভিস বা ছেলে ভোলানো ছড়া আওড়ানোর প্রয়োজন পড়ে বৈকি! অন্যদিকে, এই দেশটি রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম আর বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জনের প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু মূল ভূমিকা পালন করায় আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এর উত্তরাধিকারী হিসেবে চেতনায় সার্বক্ষণিক তা লালন করায় দেশের মানুষকে পরমুখাপেক্ষী না করে তাদের আত্মমর্যাদাশীল করে তুলতে অন্তরে-বাইরে সার্বক্ষণিক সচেষ্ট থাকবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তাই আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালনার যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি দেখতে পাই তা হলো মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশটি সৃষ্টির যাবতীয় আয়োজন। এক্ষেত্রে পথে পথে হাজারও প্রতিবন্ধকতা বিছানো রয়েছে আর তাই অনেক ক্ষেত্রেই কৌশলগতভাবে তা মোকাবেলার প্রয়োজন পড়ে বিধায় কখনও কখনও সেগুলো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যাহোক, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। এই উন্নয়নের গতি অত্যন্ত স্পষ্ট। এ উন্নয়ন রাস্তাঘাট বা ভবনাদির উন্নয়ন নয়, মৌলিকভাবে মানব উন্নয়নও বটে। আমাদের রাষ্ট্রটিকে তার মূল চেতনাধারায় পুনঃস্থাপিত করাটা সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। যদিও এক্ষেত্রে এখনও পুরো সাফল্য অর্জিত হয়নি। তথাপি চেষ্টা যে চলছে এতে কোন সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনা গণমানুষের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে এমন অনেক পদক্ষেপই নিয়েছেন যা কুচক্রীদের চোখে ভাল ঠেকেনি। কেননা, এতে তাদের স্বার্থহানি ঘটেছে যে! উন্নয়নকে অর্থবহ ও কল্যাণকর করে তুলতে এই মুহূর্তে যা-যা দরকার তন্মধ্যে বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, শিক্ষাকে সত্যিকারের জ্ঞান ও মেধা বিকাশের ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত করা, আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার বন্দোবস্ত করা, স্বাস্থ্যখাতকে মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা, মৌলবাদী দর্শনের স্থলে একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও উদার মানসকাঠামো গড়ে তোলা, বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে যাচাই-বাছাই করে তা গ্রহণ বা নির্ধারণ করা ইত্যাদি মৌলিক বিষয় রয়েছে। আমাদের অর্থনীতি দিনকে দিন চাঙ্গা হচ্ছে আর তাতে করে অনেকেই আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হওয়ার জন্য এগিয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ও আরও কিছু দেশ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তারাই যে আমাদের পরম মিত্র তা আমরা তাদের বিগত কয়েক বছরের ভূমিকাদৃষ্টে উপলব্ধি করতে পারি। রাষ্ট্রটিকে পুনরায় পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নেবার চক্র-চক্রান্ত আমরা এবারও অনেকটা পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছি নিজেদের শাণিত চেতনার পরিচর্যার মাধ্যমে। আমাদের অন্তরঙ্গ বিদেশী সুহৃদদের সহযোগিতা এক্ষেত্রে আমরা যে লাভ করেছি সে কথা তো বলাই বাহুল্য। প্রতিবেশী ভারতকে ঘিরে যে মিথ্যাচার বিএনপি গোষ্ঠী করে ফেরে তা যে কতখানি মতলবী সেটি বুঝতে হলে পাকিস্তানী সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল দুররানীর পাকিস্তানী এক আদালতে প্রদত্ত জবানবন্দী থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আইএসআই এক নির্বাচনকালে বিপুল অর্থ যোগান দেয়ার কথা তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছিলেন তার সেই বয়ানে। আমাদের অর্থনীতির আজকের এই চাঙ্গারূপ চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করছে। ভারত ইতোমধ্যে ট্রানজিটসহ বিদ্যুত, নৌ-রেল-সড়ক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি গোষ্ঠীর মনগড়া ও বিদ্বেষপূর্ণ ভারতবিরোধিতা, আবার ভারতের আশীর্বাদ লাভার্থে তাদের নানান নতজানু মানসিকতা নিশ্চয়ই দেশের সচেতন মহলের দৃষ্টি এড়ায় না। আজ ভারতের সঙ্গে আমাদের যে ছিটমহল বিনিময়সহ স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সকল বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটেছে তা যে কত বড় অর্জন সেটি আহাম্মকরা মতলবী স্বার্থেই বুঝতে বা মানতে চাইবে না সে তো জানা কথা! ভারতের সঙ্গে কিছু একটা করতে গেলেই এই স্বার্থবাজরা শিয়ালের মতো একসঙ্গে হুক্কা-হুয়া জুড়ে দেয়। অথচ, যখন চীন বা অন্য কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য বা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন চুক্তি বা সমঝোতায় তারা উপনীত হয় তখন কিন্তু তাদের মুখে কোন রা কাড়ে না। কেননা, এর মাধ্যমে তাদের গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার হয় যে! ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি, বিদ্যুত খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সহযোগিতামূলক কাজগুলো এই সরকারের আমলে এগিয়ে যাচ্ছে এবং উভয় দেশের বন্ধুত্ব যে উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা উভয় দেশের জন্যই যে কল্যাণ বয়ে আনবে এটি বুঝতে আকাশবিজ্ঞানী হওয়া লাগে কি? আমাদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে অনেকেই আজ সহযোগী হতে চাইছে আর এটি কোন একতরফা বিষয় নয়। গিভ এ্যান্ড টেকের এই দুনিয়ায় গিভ বা টেকের সীমা নির্ধারণে বিচক্ষণতা, সামর্থ্য-সক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজ স্বার্থকে অক্ষুণœ রাখা ইত্যাদি সবচেয়ে জরুরী। এসব ব্যাপারে দেশপ্রেম আর বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্যের বিকল্প নেই। আমরা যখন বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সাহায্য বা বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণের প্রস্তাব পাচ্ছি তখন তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনের বিষয়টি মাথায় রাখা একান্তই প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়ার সঙ্গে অনেক ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিশেষত চীনের সঙ্গে বোধ করি এ জাতীয় সর্বাধিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি অনেকটা সহজ বিধায় অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় মতলববাজরা তাদের বিদেশী প্রভুদের প্ররোচনায় একনেকে নানান উচ্চাভিলাষী প্রকল্প উপস্থাপন ও তা অনুমোদন করিয়ে নেবার জন্য সচেষ্ট রয়েছে এমন অভিযোগ আছে বিস্তর। আর এক্ষেত্রে চীনা ঋণের দিকেই এদের বেশি আগ্রহ বলে জানা যায়। এসব ব্যাপারে দেশপ্রেমের সঙ্গে বিষয়গুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে যদি অনুমোদন দেয়া হয় তাহলে এক সময় এই মতলবী প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এমন ভূরি ভূরি নজিরও আছে। আমাদের অর্থনীতির আজকের এই শক্ত-সামর্থ্য অবস্থানে মতলববাজরা আর তাদের বিদেশী মেন্টররা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে চাইবে আর এতদুদ্দেশ্যে সরকারের মধ্যে বা আমলাতন্ত্রের মধ্যে ঘাপটিমেরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজরা, অসাধু ব্যবসায়ী ও তাদের দালালরা সদাসচেষ্ট। বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরে দেখা যায়, চীন থেকে গৃহীত বা প্রাপ্ত ঋণের শর্তাবলী এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য মহাসঙ্কট ডেকে এনেছে। শ্রীলঙ্কায় হামবানতোতা বন্দর প্রকল্প গ্রহণ করার আগে যে আশার বাণী শোনানো হয়েছিল শ্রীলঙ্কাবাসীকে এবং এজন্য যে বিপুল চীনা ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল তা এখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি ব্যর্থ প্রকল্প হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ায় তা প্রকারান্তরে শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করেছে। অনুরূপভাবে চীনা ঋণে শ্রীলঙ্কায় যেসব অবকাঠামোগত প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল তা দেশটিকে ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলেছে। ফলে স্থানীয় অর্থনীতির ওপর বিরাট বোঝা চেপে বসেছে। এ কথা শুধু শ্রীলঙ্কার বেলাতেই নয়, মিয়ানমার, পাকিস্তান, এঙ্গোলা, ঘানা, গিনির ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। এরা সকলেই প্রলুব্ধ হয়ে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে যে দারুণভাবে সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তা প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার খবরাখবরে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এই জাতীয় ঋণের সুদ যেমন বেশি তেমনি আবার নানান শর্তের জালে থাকে বন্দী। ফলে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যখন নানান বিড়ম্বনা দেখা দেয় তখন করার থাকে না কিছুই। তখন কেবল এই কথাই মাত্র জানা যায় যে, ঋণ গ্রহীতার মাথায় হাত! সত্য বটে, শুধু চীন নয় আরও দেশ আছে যাদের ঋণ গ্রহণের পরিণতি সদ্য উন্নয়নমুখী দেশগুলোর (ঋণ গ্রহীতা) জন্য মহাসঙ্কট বয়ে আনতে পারে এবং তা আনেও। তাই চীনা ঋণ বিষয়ে বিশ্বময় যেসব অভিযোগ উঠেছে সে প্রেক্ষাপটেই চীন থেকে ঋণ গ্রহণের বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনকে অস্বীকারের উপায় নেই নিশ্চয়ই। আমাদের উন্নয়নের জন্য বিদেশ নির্ভরতা নয়, আত্মনির্ভরশীল হতে ঋণ সাহায্যের দরকার, তবে তা গ্রহণের আগে সদাসতর্ক থাকা আবশ্যক। বিশেষ করে দেশে দেশে চীনা ঋণের ব্যাপারে সঙ্কট সৃষ্টির যে অভিযোগ উঠেছে বা উঠছে তা আমলে নেয়াটা নিজেদের মর্যাদা ও উন্নয়নের স্বার্থে একান্তই জরুরী। আশা করি আমাদের এ বিষয়ক নীতিনির্ধারকরা তা মাথায় রাখতে ভুলবেন না। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×