ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সচেতনতার অভাব

জলবায়ুর পরিবর্তন ॥ দক্ষিণাঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার

প্রকাশিত: ১৭:৫৭, ২১ এপ্রিল ২০১৭

জলবায়ুর পরিবর্তন ॥ দক্ষিণাঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা বাংলাদেশে বন্যা বা জলোচ্ছাসে নয়, প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে এখন সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে বজ্রপাতে। হঠাৎ করে কেন বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে বজ্রপাতের সংখ্যা? এনিয়ে গবেষকদের ধারণা, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গবসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ। তাই এখানে বজ্রপাত বেশি ঘটছে। এরসাথে আঞ্চলিক উষ্ণতা বৃদ্ধির নানা কারণও রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশরাই হচ্ছেন নদীতে মাছ ধরা জেলে কিংবা জমিতে কাজ করা দিনমজুর। সূত্রমতে, সবশেষ চলতি মাসের ১৯ ও ২০ এপ্রিল বজ্রপাতে বরিশাল জেলার হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় চারজন নিহত ও দুইজন আহত হয়েছেন। মেহেন্দিগঞ্জ থানার ওসি মোঃ আকতারুজ্জামান জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঝড়ো বৃষ্টির মধ্যে উপজেলার কালাবদর নদীতে চার জেলে মাছ ধরছিলেন। একপর্যায়ে বজ্রপাতে জেলে উপজেলার গাগুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ইউসুব খান (২৪) এবং একই গ্রামের মোঃ মারজান (১৮) নিহত ও অপর জেলে নিজাম উদ্দিন ও ইব্রাহিম নদীতে লাফিয়ে পরে আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ নিহত দুই জেলের লাশ উদ্ধারসহ আহতদের উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছেন। এ ঘটনার মাত্র একদিন আগে ১৯ এপ্রিল বরিশালের হিজলায় বজ্রপাতে যুবলীগ নেতাসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। হিজলা থানার ওসি মাসুদুজ্জামান জানান, উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ইদ্রিস বেপারী (৪৫) তার নিজস্ব ট্রলারযোগে শরিয়তপুর থেকে হিজলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে রাত সাড়ে ১১টার দিকে হিজলার সন্নিকটে পৌঁছলে ঝড়ো বৃষ্টির সাথে শুরু হওয়া বজ্রপাতে ইদ্রিস বেপারী নিহত হন। একইদিন বজ্রপাতে উপজেলার মেমানিয়া ইউনিয়নে আমিনুর রহমান (২০) নামের এক ইটভাটা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ওই দুইদিনে জমিতে ধান কেটে বাড়ি ফেরার পথে কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীতে ভাই-বোনসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গত ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় আকস্মিক বজ্রপাতে গৌরনদী উপজেলার নতুন টরকী এলাকার ব্যবসায়ী দুলাল বেপারী (৩০) নিহত হয়েছেন। কালকিনি উপজেলার রামেরহাট গ্রামের আইউব আলী বেপারীর পুত্র দুলাল ঝড়ো বৃষ্টির মাঝে ঘরের বাহিরে বের হলে আকস্মিক বজ্রপাতে সে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় তার (দুলাল) স্ত্রী গুরুতর আহত হয়। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর সাড়ে তিন থেকে পাঁচ শ’ মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। এ মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয় মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবছর তা আগে থেকেই শুরু হয়েছে। বড় কোনো ঝড় বা বৃষ্টিপাত ছাড়াই চলতি মাসে সামান্য বৃষ্টির সাথেই ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। আর এতে করে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। মেঘের সাথে মেঘের ঘর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় বজ্রপাত। যদিও সরকারী পর্যায়ে বজ্রপাতকে কোনো দুর্যোগ নয়, আপদ হিসেবেই আলোচনা করা হয়। গবেষকরা মনে করছেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে আগাম বার্তা দেয়ার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন, পাঠ্যসূচিতে বজ্রপাতে করণীয় বিষয় অন্তর্ভূক্তকরণ, বজ্রপাত ঝুঁকি নিরূপণে জাতীয় গাইডলাইন প্রণয়ন, বজ্রপাত ব্যবস্থাপনায় জিও-এনজিও সমন্বয় সাধন, বিল্ডিং কোড মেনে ঘরবাড়ি নির্মাণ, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার, সচেতনতা সৃষ্টিতে স্থানীয় সরকার কাঠামোর ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা, বজ্রপাত হয় এমন মেঘের ধরণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করাসহ বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ব্যক্তির সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন তথা উষ্ণায়নের কারণে বজ্রপাতের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা তার ওপরও গবেষণার প্রয়োজন। বজ্রপাতে পুরুষ মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বজ্রপাতের ঘটনা খোলা জায়গায় বেশি হয়। ফলে মাঠে কাজ করা মানুষ ও নদীতে মাছ ধরা জেলেরা বজ্রপাতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। গত বছর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১০ জুন বাবুগঞ্জের ভুতেরদিয়া গ্রামের সাইদুল হাওলাদার (৩০) ট্রাক্টর নিয়ে মাঠ থেকে ফেরার পথে বজ্রপাতে মারা গেছেন। একইদিন গুড়ি গুড়ি বর্ষার সময় একই গ্রামের এনামুল, আলাউদ্দিন ও দীন ইসলাম একটি গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। দূর্ভাগ্যবশত ওই গাছে বজ্রপাত আঘাত হানলে তারা তিনজনই গুরুতর আহত হন। ১৩ জুন দুপুরে বৃষ্টির মধ্যে মাঠে কাজ করার সময় বরিশালের মুলাদী পৌর এলাকার পাতারচর গ্রামে ফজলুল হক হাওলাদার (৫৫) নামের এক কৃষক ঘটনাস্থলেই মারা যান। ১২ জুন দুপুরে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আন্দারমানিক গ্রামে মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে রুস্তম আলী সিকদার (৫০) ও ইসাহাক আলী হাওলাদার (৪০) নামের দুই কৃষক মারা গেছেন। এসময় আহত হয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক (৪৫) নামের এক দিনমজুর। একইদিন চরহোগলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থী সুরমা খানম ও আবু বক্কর সিদ্দিক বজ্রপাতে আহত হয়েছে। ওইদিন দুপুরে মাঠে গরু আনতে গিয়ে আকস্মিক বজ্রপাতে হিজলা উপজেলা সদরের বাসিন্দা হাজেরা বেগম (৫০) নামের এক নারী ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। এসময় দুটি গবাদিপশু মারা যায়। আহত হন হাজেরার স্বামী রাজ্জাক সরদার। একইসময় উপজেলার মেমানিয়া গ্রামে বজ্রপাতে আহত হন নুরুল ইসলাম আকন। একই মাসে বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর গ্রামের গ্রামপুলিশের দফাদার আবুল হোসেন বজ্রপাতে আহত হয়েছেন। মারা গেছে তার একটি গবাদি পশু। বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ এলাকা সংলগ্ন আড়িয়াল খাঁ নদীতে মাছ ধরার সময় বজ্রপাতে নাসির বেপারী (৪০) নামের এক জেলে মারা গেছেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রপাতে অসংখ্য ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। বজ্রপাত থেকে রক্ষায় জনসচেতনতা : বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাত থেকে রক্ষায় কিছু বিষয় আছে যেগুলো মেনে চললে খুব সহজেই বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যেমন বজ্রবৃষ্টিতে যে মেঘগুলি তৈরি হয়, সে মেঘগুলি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে। এভাবে কোন কালো মেঘ আকাশে দেখা দিলে কিংবা বিদ্যুৎ চমকালে বা বজ্রপাতের গর্জন শোনা গেলে খোলা জায়গায় থাকা যাবেনা। কোন বিল্ডিংয়ের ভেতরে বা কোন আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যেতে হবে। তবে এসময় যারা টিনের চালা বা ছাউনির নিচে নিরাপদ মনে করে থাকেন তাদের বজ্রপাতের সময় খোলা জানালার পাশে কিংবা ঘরের বারান্দায় যাওয়া কোন প্রকারেই ঠিক হবেনা। এ সময় কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির প্লাগ খুলতে যাওয়া বা স্পর্শ করাও ঠিক নয়। বজ্রপাতের সময় উঁচু স্থানের বড়গাছ, বিদ্যুতের খুটি, উচু কোন জিনিস যা মাটির সাথে সম্পৃক্ত তাতে আঘাত হানে। অনেক সময় দেখা যায়, আকস্মিক বজ্রপাতের সময় রাস্তা-ঘাটে কিংবা মাঠে থাকা অনেকেই বড়গাছের নিচে আশ্রয় নেয়, এটা মোটেও সঠিক কাজ নয়। সম্ভব হলে বড়গাছের পাশের ছোট গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। অথবা নিচু জায়গায় দাঁড়ানো যেতে পারে। আর যদি খোলা মাঠে কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, সেক্ষেত্রে ছোট হয়ে গুটিয়ে বসে পড়তে হবে। আর পুকুরে বা নদীতে থাকলে, উপরে উঠে আসতে হবে। নৌকায় থাকলে ছাউনির নিচে যেতে হবে। আর কেউ ছাতা ব্যবহার করে রাস্তায় বের হলে সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে ওই ছাতার ডাঁটিটা যেন ধাতব বস্তুর না হয়। ছাতার ডাঁটিটি কাঠের বা প্লাস্টিকের হলে ভাল হয়।
×