ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

পড়শি বসত করে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২০ এপ্রিল ২০১৭

পড়শি বসত করে

বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও নীলের মতো সাতটি রং যখন একত্রে কিন্তু পৃথক পৃথক সত্তায় প্রকাশিত হয় তখন তা সপ্তবর্ণের রংধনু। অপরদিকে এই সাত রংই যখন তাদের স্বকীয় সত্তা হারিয়ে পরস্পর পরস্পরে মিলেমিশে একাকার হয় তখন তা সাদা। সভ্যতার সঙ্কট যান্ত্রিকতা, যান্ত্রিকতার অনিবার্যতা পারস্পরিক বিচ্ছেদ আর বিচ্ছেদের ফলাফল একাকীত্ব তথা নিঃসঙ্গতা। এই নিঃসঙ্গতা এক অর্থে জীবনের সকল রঙের বিলীনতা। এই বিলীন রং, বিলীন সময়ের বিপরীতে বর্ণিল রং, বর্ণিল সময়কে ফিরিয়ে এনে সময়কে অর্থবহ, জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলার নাটক পড়শি বসত করে। গত ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৭ দিনব্যাপী উদযাপিত সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব ও স্মারক সম্মাননা ২০১৭ এর দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয় কলকাতার নাট্যদল কার্টেন কল প্রযোজিত, নাট্যকার মৈনাক সেনগুপ্ত রচিত, তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত নাটক পড়শি বসত করে। পাড়া পড়শির প্রয়োজনীয়তা কত ইনিয়ে বিনিয়ে এবং ফেনিয়ে যে বলা যেতে পারে সেটা পড়শি বসত করে নাটকটা যারা দেখলেন না তারা কল্পনাও করতে পারবে না। স্বামী ভাস্কর আর্থিক উন্নতির জন্য ধাবমান ফলে গৃহিণী সুনেত্রা এক অর্থে গৃহবন্দী। কথা বলার অবলম্বন একমাত্র তার গর্ভধারিণী মা তাও কালেভদ্রে বেড়াতে এলে। চার দেয়ালের পেষণে নিষ্পেষিত সুনেত্রা একদিন দেখা পায় পড়শি আঁখির যে সুনেত্রার মনের সাদা-কালো ক্যানভাস, রূপক কল্পতরু ফেরিওয়ালার রঙিন আভায় উদ্ভাসিত করে তোলে। ফলে সুনেত্রা খুঁজে পায় জীবনের সৌন্দর্যতা, বেঁচে থাকার আনন্দ আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার সহজিয়া মানসিকতা। আর সেখানেই শেষ হয় মৈনাক সেনগুপ্তের বিলম্বলয়ের নাটক পড়শি বসত করে। স্লথগতির নাট্যকার মৈনাক সেনগুপ্ত আর কৌশলী নির্দেশক তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় মিলেমিশে দেড় ঘণ্টার নাটকে প্রথম এক ঘণ্টা জুড়ে ঢাকার দর্শকদের যে সেলে ফেলে টর্চার করলেন তাতে কিছু ভাবনা সত্যিই ভাববার। প্রথমত, কার্টেন কলের মতো নাট্যদল কি সত্যিই কলকাতার প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সারির দল! যদি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সারির দল হয় তবে সেটাই কি ঢাকায় আমন্ত্রিত হওয়ার প্রাক যোগ্যতা। দর্শক কমে যাওয়ার এই ক্ষয়িষ্ণুকালে কলকাতার নাটকের নির্ধারিত দর্শকের ওপর এই পীড়ন কিছুতেই মানা যায় না। দ্বিতীয়ত, ঢাকার নাট্যচর্চা সম্পর্কে নির্দেশক তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় কি ন্যূনতম ধারণা রাখেন! তিনি কি জানেন, ঢাকার মঞ্চে রয়েছে রামেন্দু মজুমদার, আলী যাকের, সৈয়দ জামিল আহমেদ কিংবা মামুনুর রশীদের মতো নাট্যব্যক্তিত্বরা। যদি জানবেন তবে চেষ্টা করেও এত খারাপ করা যায় না যা তিনি করলেন পড়শি বসত করে নাটকে, সেখানে নাটক শেষে এত গর্বের সঙ্গে বক্তব্য রাখলেন কিভাবে! তৃতীয়ত, ঢাকার মঞ্চে যেমন কিছু স্বল্পবুদ্ধির নির্দেশক আছেন যারা কথায় কথায় প্রায়ই বলেন, আমি নাট্যকারের কিছু রাখিনি। পড়শি বসত করে নাটকে এক ঘণ্টার পর মঞ্চে, অভিনেতা গৌতম হালদার তার সম্মোহীন অভিনয় নিয়ে ঢুকে যেভাবে নাট্যকার নির্দেশক এবং অপরাপর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভর্ৎসনার হাত থেকে সুরক্ষা দিলেন তাতে তো ঢাকার পরিশ্রমী অভিনেতা-অভিনেত্রী ভাবতেই পারে, আহত নাট্যকারের সঙ্গে সহমর্মী হয়ে সেও বলবে, আমি আমার অভিনয়ে নির্দেশকের কিছু রাখিনি। রাখা না রাখা যার যার ব্যাপার বললেই বলা শেষ হয়ে যায় না। ভাল কিছুর পেছনে ব্যাখ্যা থাকে। কল্পতরু ফেরিওয়ালারূপী অভিনেতা গৌতম হালদারের চরিত্র মনের মানুষ, সহজ মানুষ যে কিনা মনের কথা বলে। মন যখন শুকিয়ে যায়, মরে যায় তখন সে বাস্তবের ছোঁয়ায় মনকে জাগায়, বাঁচায়, মনকে দিয়ে কথা বলায়। ফলে সে কখনও প্রেমিক কিংবা বাউল অথবা প্রকৃতি। এ্যাবসার্ডিটি তার অস্তিত্বে কিন্তু সংযোগ স্থাপন রিয়েলিটিতে। ওড়নার আদলে তার রঙের ফেরি সে তো জীবনকে রাঙিয়ে তোলা। সবুজে প্রকৃতি, বন্যতা, আদিমতার অন্বেষণ। নীল আকাশের মতো হৃদয়ের বিশালতার ক্যানভাস। লালরূপে মনের আগুনে সৃজন-বর্জন। জলের মতো সাদার স্বচ্ছতায় সব ধুয়ে মুছে সাফ। হলুদে নিলুয়া বাতাসে ঘা ভাসানো। মেটে রং তথা মাটি ধারণ-সহন ও বহনের প্রতিরূপ। অভিনেতা গৌতম হালদার রূপী কল্পতরু ফেরিওয়ালা শেষ পর্যন্ত মনের বিষাদকে সরিয়ে নির্মল আনন্দ পাইয়ে দেয়। কার্টেন কলের অতিথি অভিনয় শিল্পী গৌতম হালদার যেমন দলের সাপেক্ষে অতিথি পড়শি হয়েও প্রযোজনায় মূল পরিবার ঠিক তেমনি পড়শি বসত করে প্রযোজনায় সার্বিক যন্ত্রণার বিপরীতে (অবশ্য সুনেত্রারূপী সঞ্জিতা মুখার্জীর শেষ গায়কী আনন্দের) গৌতম হালদারের অভিয়ন স্বল্প হলেও তা তৃপ্তির। অতৃপ্তির পরিবার কিন্তু তৃপ্ত পড়শির (অতিথি অভিনেতা বিবেচ্য) মঞ্চায়ন পড়শি বসত করে।
×