ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে নতুন মোড়

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে নতুন মোড়

সম্প্রতি উত্তর-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন নাটকের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। এর কয়েকদিন পর দুই মহিলার হাতে উত্তর কোরীয় নেতা, কিম জংউনের সৎভাই নিহত হন। মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্টে তার মুখে রাসায়নিক ছুড়ে মেরে ফেলা হয়। মালয়েশীয় পুলিশের সন্দেহ হত্যার আয়োজকদের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার কোন একজন কূটনীতিক থাকতে পারেন। ঘটনার পর সেই আয়োজকদের বেশ কয়েকজন পিয়ংইয়ংয়ে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন এক ধোঁয়াশা অবস্থার মধ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চীন ঘোষণা করে যে এ বছরের শেষ দিন পর্যন্ত সে উত্তর কোরিয়া থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ রাখবে। খবরটা এমন কিছু আহামরি নয়। তবে চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় এই সিদ্ধান্তকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বেজিং থেকে প্রকাশিত গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, পরমাণু কর্মসূচী খর্ব করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের আরোপিত অবরোধ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যে মতপার্থক্য আছে সেটাকে কাজে লাগানো উত্তর কোরিয়ার পক্ষে কঠিনতর হয়ে পড়বে। চীন হয়ত বিশ্ববাসীকে এই সঙ্কেত দিতে চায় যে সে তার এই ঝামেলা বাধানো বন্ধু রাষ্ট্রটির ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। কিংবা গোটা ব্যাপারটাই হয়ত স্রেফ লোক দেখানো কয়লা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে পিয়ংইয়ংকে যে বার্তাই দেয়া হোক না কেন তার সুর কিছুটা নরম করে ফেলা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি চীনা পররাষ্ট্র দফতরের প্রকাশিত বার্তায়। ওতে বলা হয় কয়লা আমদানি বন্ধ রাখা হচ্ছে কারণ জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞায় এ বছর চীনকে উত্তর কোরিয়া থেকে যে পরিমাণ কয়লা আমদানি করতে দেয়া হয়েছে চীন ইতোমধ্যে তার চেয়ে বেশি কয়লা আমদানি করে ফেলেছে। জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞার প্রতি চীন গত বছরের মার্চ মাসেই সমর্থন জানিয়েছিল। কাজেই সেই নিষেধাজ্ঞা মানা চীনের জন্য বাধ্যবাধকতার ব্যাপার। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা চীনের কয়লা আমদানি বন্ধের পেছনে যে কারণ দেখানো হয়েছে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করে। তারা বলেন চীন তার বার্ষিক কোটা ৭৫ লাখ টন কয়লা মাত্র ৬ সপ্তাহের মধ্যে আমদানি করে ফেলবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এপ্রিল বা মে মাসের আগে সেই বার্ষিক আমদানি কোটা পূরণ করা সম্ভব নয়। আর সেই সীমা ছাড়িয়ে গেলেও চীনের তাতে খুব একটা যায় আসে না। গত বছর চীন অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে তিনগুণ বেশি কয়লা উত্তর কোরিয়া থেকে আমদানি করেছিল এবং এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বিরাজমান একটি ফাঁককে কাজে লাগানো হয়েছিল। ফাকটা হলো এই যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া দেশটার সঙ্গে বাণিজ্য করা যাবে যদি তা সে দেশের সাধারণ নাগরিকদের জীবনমাত্রায় সহায়ক হয়। সুতরাং কোটা পূরণ করার আগেই কয়লা আমদানি বন্ধের তারিখটা এগিয়ে আনার মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই উত্তর কোরিয়াকে একটা কড়া বার্তা পৌঁছে দিয়েছে চীন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে উত্তর কোরিয়া তার সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রার জন্য কয়লা রফতানির ওপর নির্ভর করে। কয়লা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তটা এত প্রকাশ্যে ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোষণা করে চীন উত্তর কোরিয়াকে দেখিয়ে দিতে চায় যে দরকার হলে সে পিয়ংইয়ংকে কঠিন অবস্থায় ফেলতে পারে। উত্তর কোরিয়ার মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চীনের বিভক্তির কারণ ঘটিয়েছে। কারণ ওই পরীক্ষা থেকে বোঝা যায় যে উত্তর কোরিয়া চিহ্নিত করতে পারা কঠিন এমন ভ্রাম্যমাণ উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে অল্প সময়ের নোটিসে কিভাবে এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে হয় তা শিখেছে। কিম জং নামের হত্যাকা- হয়ত এর চেয়েও বড় আঘাত চীনের কাছে। কারণ কিম চীনের ভূখ- জুয়ার অন্যতম স্বর্গরাজ্য ম্যাকওয়ে সম্ভবত চীনা সরকারের ছত্রছায়ায় বসবাস করছিলেন। চীনা কর্মকর্তারা হয়তবা আশা করেছিলেন যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তদ্বার নীতির সমর্থক কিম একদিন তার সৎভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হবেন। কিমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই আশার সমাপ্তি ঘটল। এ ঘটনার দ্বারা চীনকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো যে চীন ও অন্যান্য দেশ যাই ভাবুক নাই ভাবুক উত্তর কোরিয়ার বর্তমান একনায়ক তার নিজস্ব কায়দায় দেশ শাসন করতে বদ্ধপরিকর। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে চীনাদের মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান হতাশার সঞ্চার হয়েছে প্রতিবেশী দেশটি সম্পর্কে সমালোচনার প্রতি বেজিংয়ের শিথিল মনোভাবের মধ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত একটি পত্রিকায় এক নিবন্ধে বলা হয়েছিল যে চীনের উচিত উত্তর কোরিয়াকে পরিত্যাগ করা ওই নিবন্ধের জন্য পত্রিকার সম্পাদকের চাকরি গিয়েছিল। ইদানীং শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই একই রকমের ধারণা ব্যক্ত করছেন। উত্তর কোরিয়া সংক্রান্ত বিতর্ক এখন প্রকাশ্যেই অনলাইনে আসছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো অ-সেন্সরকৃত। কিম জং নামের হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে চীনাদের তরফ থেকে উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে বিদ্রƒপের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। চীন এখনও উত্তর কোরিয়াকে দক্ষিণে মোতায়েন মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় রক্ষার অঞ্চল বলে গণ্য করে। তবে উত্তরোত্তর চীনারা পিয়ংইয়ংকে একটা দায় বা বোঝা বলেও ভাবছে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×