ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনোয়ার হোসেন

বাংলাদেশে তামাক কর প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

বাংলাদেশে তামাক কর প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়

আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, করারোপের মাধ্যমে তামাকের প্রকৃত মূল্য ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মানুষের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশ পরিমাণ হ্রাস পায়Ñ যা জনস্বাস্থ্যের নিরিখে প্রশংসনীয় সূচক হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বাংলাদেশে তামাক-কর বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কার্যকর করারোপের অভাবে এখানে তামাকপণ্যের প্রকৃত মূল্য বৃদ্ধি পায়নি, উল্টো সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকপণ্যের দাম সস্তা থেকে সস্তাতর হয়েছে। এর কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করা যেতে পারে। এক. বাংলাদেশে কোন তামাক-কর নীতিমালা নেই অর্থাৎ এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, বরং কর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির প্রাধান্য প্রবল। দুই. বাংলাদেশে তামাকের ওপর বিদ্যমান কর-কাঠামো অত্যন্ত জটিল ও পুরনো। বর্তমানে তামাকের ওপর করারোপের ক্ষেত্রে এ্যাডভ্যালোরেম (মূল্যের শতকরা হার) প্রথা কার্যকর রয়েছে, যা বিশ্বের মাত্র ৫/৬টি দেশে চালু আছে। উপরন্তু, করারোপের ভিত্তি (বেইজ) তামাকপণ্য ভেদে ভিন্ন ভিন্ন যেমন, সিগারেটের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর প্রথা, বিড়ির ক্ষেত্রে ট্যারিফ ভ্যালু এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের ক্ষেত্রে এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা চালু রয়েছে। তিন. বাজেটে তামাকপণ্যে করারোপ জনগণের বাৎসরিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চার. বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোকে বাজেটে ছাড় দেয়ার প্রবণতা। যেমন ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দামী সিগারেটের করহার প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে এক বছরে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সিগারেট ভোক্তারা চলতি বছরে আরও কমদামে সিগারেট সেবন করতে পারছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। অন্যদিকে দেশীয় শিল্প বিবেচনায় বিড়িকে ছাড় দেবার প্রবণতা নীতি-নির্ধারকদের মাঝে প্রবল। অথচ বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ফলে মানুষের আয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জনগণ বিড়ির সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, ২০০৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন, যার মধ্যে ২৩% (২ কোটি ১৯ লাখ) ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করেন এবং ২৭.২% (২ কোটি ৫৯ লাখ) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার নারীদের মধ্যে অনেক বেশি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশের ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তামাকপণ্য ব্যবহার করে (গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৩)। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করে (ওঐগঊ, ২০১৩)। আশার কথা, গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান স্পীকার সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের পূর্বে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তামাকের ওপর বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছেÑ যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। উন্নয়নের বৈশ্বিক এজেন্ডা ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ নির্দিষ্ট সময়ে অর্জন করতে সরকার বদ্ধপরিকর। তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে এই লক্ষ্য অর্জন এক কথায় অসম্ভব। এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায়Ñ ১. তামাকের ওপর বিদ্যমান জটিল শুল্ক-কাঠামো সহজীকরণ যেমন, করারোপের ক্ষেত্রে সিগারেটে পৃথক মূল্য স্তর, বিড়িতে ট্যারিফ ভ্যালু, ধোঁয়াবিহীন তামাকে এক্স-ফ্যাক্টরি প্রথা তুলে দিয়ে একক কর কাঠামো চালু করা এবং এ্যাডভ্যালোরেম কর এর পরিবর্তে স্পেসিফিক অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কর ধার্য করা। ২. একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, যেখানে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তালমিলিয়ে প্রতিবছর বাজেটে তামাকে কর বৃদ্ধির বিধান থাকবে এবং ৩. করবৃদ্ধির পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সহায়তায় লক্ষ্যে তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন ও প্রতিহত করা। বর্তমান বাংলাদেশ তরুণদের। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশই তরুণ। এই তরুণ প্রজন্মকে একটি তামাকমুক্ত সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দেয়া এখন সময়ের দাবি। লেখক : টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি মনিটরিং এক্সপার্ট, প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান),
×