ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

সহজ পথ বেঁধে দিক বন্ধনহীন গ্রন্থি

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

সহজ পথ বেঁধে দিক বন্ধনহীন গ্রন্থি

দেশকাল বিচরণ জগত সব আলাদা। চে গুয়েভারা বিপ্লবের প্রতীক। লাতিন আমেরিকাতে শুধু নয়, সারা পৃথিবীতে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারুণ্য ধারণ করছে তাঁকে। লালনের বিস্তৃতি চে’র মতো বিশ্বময় নয়। তবে চে’র ছাপচিত্র বুকে নিয়ে যারা চারপাশ বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখে তারাই এগিয়ে নেয় লালনকে। ছেঁউড়িয়ার আখড়ার সুর বাজে শহুরে তরুণের গলায়। সে সুরে বহুজাতিক কোম্পানি মাতাল হয়নি এখনও। চে’র প্রতিকৃতি নিয়ে যেমন হয়েছে। হয়ত তাই লালন ছড়িয়ে পড়েনি বিশ্বময়। আর চে’র ধারাল চেহারা ‘বিপ্লবী ব্র্যান্ড’ হয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের ঘরে ঘরে। তাই মৃত্যুর চার দশকের বেশি সময় পরও বিশ্বজুড়ে চে’র এ জনপ্রিয়তার মূলে সবটুকুই যে বিপ্লবী চেতনা তা আর বলা যায় না। লালনের গানে নতুন করে উদ্বেল তারুণ্যও তাঁর দর্শনে আলোড়িত হয়ে কণ্ঠে তোলেনি তাঁকে। হয়ত এর বাইরের দিকটিই বেশি আকৃষ্ট করেছে। আখড়াই জীবন, প্রথাবদ্ধ জীবনযাপনের বাইরে একটু অন্য ঘরানায় চলাফেরার মাদকতায় বিহ্বল তারা অথবা লালনের গানে মানুষ ভজার দিকটিও ছুঁয়ে যেতে পারে। বাউলের জন্মও তো এক প্রতিবাদের মধ্যে। যেখানে প্রতিবাদ সেখানে তারুণ্যÑ এমনও হতে পারে। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক কাঠামোতেই কি এক আশ্চর্য উপাদান কাজ করে সেই চৈতন্যের যুগ থেকে। জাতপাতের লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত এ সমাজে চৈতন্য এনেছিলেন ভক্তি ও প্রেমের ধারা, যা শুধু ধর্মীয় ভাবের মধ্যে সীমিত থাকেনি; সাহিত্য সঙ্গীত-নৃত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যে এক বৈষ্ণব পদাবলিতেই আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকা যায়। কীর্তন তো ছিল চৈতন্যের ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রকাশের মূল অনুষঙ্গ। কীর্তনে প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথও ব্রজবুলি ভাষায় লিখে ফেলেছিলেন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি।’ নৃত্যেও কি কম? ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ঐতিহ্যিক নাচগুলো যেমন কথাকলি, মণিপুরী, ওড়িশি, কুচিপুরী ইত্যাদি ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়েছিল সে সময়। কীর্তনের পর বিকশিত হলো আরেক বিস্ময়Ñ বাউল গান। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় সে গানে ইতিহাস গড়লেন লালন ফকির। একটা সময় পর্যন্ত এ গান নির্দিষ্ট গ-িতেই সীমিত ছিল। শহুরে শ্রোতার কানে প্রথমে তা পৌঁছে দিলেন ফরিদা পারভীন। তার গায়কী সেই যে মন জয় করল শ্রোতার তার রেশ থেকে গিয়েছিল হয়ত। বেশ কিছু বছর তেমন ওঠানামা চোখে পড়েনি। তারপর এ শতকের শুরুতে তরুণরা হঠাৎই মনোযোগী হয় লালনে। এবার সূত্রধরের কাজ করেছেন সম্ভবত আনুশেহ আনাদিল। কৃত্রিম আখড়াই ঢঙে বিদেশে শিক্ষিত আনুশেহর গলা যখন চড়ায় ওঠে তখন কেঁপে যায় শহুরে শ্রোতার কান। বিশেষ করে তরুণদের। তারপর ক্লোজআপ তারকা বিউটি, সালমা পর্দার ওপার থেকে হাজারো দর্শকের কানে পৌঁছায় লালনগীতির বার্তা। কি সে বার্তা? আসলে কি পৌঁছানো যায় তা এত সহজে? সহজ নয় মোটেই। বাউল তত্ত্বের ভেদ বোঝা কঠিন। দু’দশক ধরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ, বীরভুম-বর্ধমান, কুষ্টিয়া-মেহেরপুরের বাউল অঞ্চল ঘুরে লেখক গবেষক সুধীর চক্রবর্তী বাউল বিষয়ে ‘গভীর নির্জন পথে’ নামে অসাধারণ এক বই লিখেছেন। সে বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম কথাগুলো এ রকম, ‘শোনা যায় যান্ত্রিক সভ্যতা যত এগোয়, সভ্য মানুষ তত কৃত্রিম হতে থাকে। তার মুখে এঁটে বসে যায় এক মুখোশ শিষ্টতার, সৌজন্যের। পরে অনেক চেষ্টা করলেও তার সত্যিকার মুখশ্রী আর দেখা যায় না, সে নিজেও এমনকি দেখতে পায় না। বলা হয়, গাঁয়ের মানুষ নাকি একটু অন্য রকম। সভ্যতার কৃত্রিমতার আঁচ যদিও তাদের গায়ে লাগছে একটু আধটু, তবু তারা সরল প্রাণবন্ত আতিথ্যপ্রবণ। এ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র ও ভিন্নতর। অন্তত শতকরা আশিভাগ গ্রামবাসীর মনের কথা টের পাওয়া যে কঠিন তা আমি বলতে পারি। তাঁদের মুখে মুখোশ নেই, কিন্তু আছে এক কাঠিন্যের আবরণ। আপাত সারল্যের অন্তরালে সেই কঠিনতা প্রায় দুষ্প্রবেশ্য। তবে একবার সেই শক্ত খোলা ভাঙতে পারলে ভেতরে নারকোলের মতোই স্নিগ্ধ শাঁসজল। কয়েক শতাব্দীর তিক্ত লেনদেন, ব্যর্থ আশ্বাস আর নির্লজ্জ শোষণ গাঁয়ের মানুষকে শহুরে বাবুদের সম্পর্কে করে তুলেছে সন্দিহান। জীবন ও জগত সম্পর্কে তাঁদের দেখা জানা আর শহরের মানুষের বইপড়া তত্ত্বে এত ফাঁক তঁাঁরা দেখতে পান যে, আমাদের জন্য তাঁরা সব সময় রেখে দেন এক অন্তর্লীন করুণাবোধ। তাঁদের মূঢ়, ম্লান মূক মুখে ঢাকা আছে এ দারুণ কৌতূহল, যার বিনিময় তঁাঁরা নিজেদের মধ্যে করেন অবসর সময়ে।’ যাঁরা লালনের গান গাইছেন, তাঁরা ভালবেসেই গাইছেন। এর দর্শন বা তত্ত্ব হয়ত জানেন অথবা জানেন না। শিল্পীর কণ্ঠ শ্রোতার মন ছুঁতে পারলেই সার্থক। যিনি আরও জানতে চান তিনি নিজ গরজে জেনে নেন। তবে গাওয়া ও শোনা দুই-ই হয়ত আগ্রহ বাড়িয়েছে লালনের প্রতি। সে আগ্রহকে পুঁজি করে গৌতম ঘোষ বানিয়ে ফেলেন লালনের জীবননির্ভর চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’। পরিচালকের কেন মনে হলো এমন ‘লালন’ নির্মাণের কথা বোঝা মুশকিল। ধোপ দুরস্ত পোশাক আর পরিপাটি কেশ বিন্যাসে লালনকে মনে হয় যত না সাধক তিনি তারচেয়ে বেশি সমাজ সংস্কারক। সতীদাহ প্রথার বলি অনেক মেয়েকে উদ্ধার করে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁর আখড়ায়। সেখানে এককালের গ্রুমিং করা চিত্রনায়িকারা সেকালের চরিত্রে রাঁধেন-বাড়েন দল বেঁধে গান করেন। প্রতিদিন আট-দশ জন মানুষের রান্নাÑ কোত্থেকে এর যোগান আসে। আখড়া জীবনে এতসব আয়োজনে আয়ের উৎস কি, সে সব প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যায়। আখড়ায় কাঙ্গাল হরিনাথ ও মীর মশাররফ হোসেনের যাওয়া-আসার সূত্রে লালনের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল তাদের। তারাই জানান তাঁর ওপর হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই ক্ষেপেছে। তাদের সঙ্গে বাহাস করেন তিনি। বড় সাধারণ মনে হয়। বাংলা ইংরেজী ক্যালেন্ডারের যোগ-বিয়োগে লালনের মৃত্যু সাল দাঁড়ায় ১৮৯০। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১তে। সে হিসাবে প্রায় ৩০ বছর লালনকে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর থেকে অনেক সুর নিয়েছিলেন তিনি। লালনের দর্শনেও প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আশ্চর্য হলো রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বও নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় শান্তিনিকেতনে প্রথম দিকে জাতপাতের কঠোর অনুশীলন করেছিলেন। ষোল শতকে চৈতন্যের জাগরণকেও আবার গ্রাস করেছিল ব্রাহ্মণবাদ। কিন্তু এর লোকায়ত ধারা আঁকড়ে ধরে ছিল সাধারণ মানুষ। তারা ভক্তি ও ভালবাসার চর্চায় একে এগিয়ে নিয়েছে। অনেক ধারা-উপধারায় ভাগ হয়ে নিজেদের মতো করে চর্চা করেছে। সেই সেক্যুলার আদর্শ লালনের হাতে পেয়েছে অন্য রকম মুক্তি। ওই মুক্তির আস্বাদই হয়ত টানছে তারুণ্যকে। জীবনকে ছকে বাঁধা ফ্রেম থেকে বের করতে তরুণরাই বিদ্রোহ করে প্রথমে। উদ্দেশ্য ও অভিযাত্রার হিসাব-নিকাশের গুরুত্ব সেখানে কম। [email protected]
×