ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুফল পাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা

সহজে কৃষি উপকরণ ক্রয়ে কৃষকদের জন্য ‘এ-কার্ড’ চালু

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

সহজে কৃষি উপকরণ ক্রয়ে কৃষকদের জন্য ‘এ-কার্ড’ চালু

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কৃষকরা বেজায় খুশি! এখন তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ কিনতে পারছেন খুব সহজশর্তে। এতে তাদের কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা সহজ হয়ে উঠেছে। আর এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ‘এ-কার্ড’। নগদ ঋণের পরিবর্তে এ কার্ড দিয়ে তারা কৃষিপণ্য কিনতে পারছেন নির্ধারিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। যেমন বীজ, সার, কীটনাশক ও জ্বালানি ইত্যাদি। অতিসম্প্রতি ‘এ-কার্ড’ ব্যবহার করে ফরিদপুর জেলার দুই উপজেলা এবং দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় এর সুফল ভোগ করছেন কৃষকরা। জানা গেছে, প্রকল্পের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ‘ব্যাংক এশিয়া’। কৃষি উপকরণ কিনতে একজন কৃষককে দেয়া হয়ে থাকে ১০,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ। এ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে ১০ শতাংশ সুদে ছয় (৬) মাস পরে। ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ পরিশোধের পর ‘এ-কার্ড’ দিয়ে একজন কৃষক পুনরায় ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ নিতে পারবেন। প্রকল্পের সংগঠকরা জানিয়েছেন, ‘এ-কার্ড’-এর সুদের হার অন্যান্য এনজিওগুলোর তুলনায় অনেক কম। এক্ষেত্রে ঋণ বিতরণকারী অন্য এনজিওগুলো সপ্তাহ শেষে কিস্তি পরিশোধে কঠোর নিয়ম অনুসরণ করে এবং ঋণের বিপরীতে ২৫ শতাংশ হারে সুদ নিয়ে থাকে। কিন্তু ‘এ-কার্ড’ ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এর বদৌলতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঠপর্যায়ের কৃষকরা দেশের প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে থাকেন। ‘এ-কার্ড’-এর মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতারা অর্থ পরিশোধের ছয় মাস সময়সীমা শেষ হওয়ার একদিন আগেও সমুদয় ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেয়ে থাকেন। এ প্রকল্পের প্রণেতা ও বাস্তবায়নকারী ‘ইউএসআইডি’র (এগ্রিকালচার এক্সটেনশন সাপোর্ট এ্যাক্টিভিটি-এইএসএ) এক কর্মকর্তা এ কথা জানান। প্রসঙ্গত, ‘এ-কার্ড’ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা আহছানিয়া মিশন (ড্যাম)। এর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংক এশিয়া। সার্বিকভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতা দিচ্ছে ‘কেয়ার বাংলাদেশ’, ‘এমপাওয়ার’ ও ‘এমস্টার-এফএইচআই-৩৬০’। ফরিদপুরে প্রকল্প বাস্তবায়নে এনজিওর দায়িত্ব পালন করছে ‘সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট কমিটি’ (এসডিসি)। প্রকল্প এলাকায় বর্তমানে প্রায় ৫০০ কৃষক এ ঋণের সুবিধা ভোগ করছেন। কৃষকদের নিজ নিজ ব্যাংক হিসাবে ঋণের ১০,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা গচ্ছিত থাকে, যা দিয়ে তারা নির্ধারিত এজেন্টের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ কিনে থাকেন। ফরিদপুর সদর উপজেলার রুবিয়া বেগম জানালেন, তিনি ‘এ-কার্ড’ পেয়েছেন। এ দিয়ে চাষের সময় তিনি বীজ, সার, কীটনাশক ও জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনেন। এর ফলে তিনি বেশ উপকৃত হয়েছেন। এসব নিয়ে আগের মতো তাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হয় না। সময়মতো সবকিছু হাতের কাছে পেয়ে যান। রুবিয়া বেগম আরও বলেন, নির্ধারিত দোকান থেকে তিনি ‘এ-কার্ড’ দিয়ে চাষের জন্য কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করে থাকেন। এ কারণে তিনি এখন পুরোপুরি দুশ্চিন্তামুক্ত। চাষের সময় এলে আগে কৃষি উপকরণ ও সেচের পানি কেনা নিয়ে তাকে নানান সমস্যায় পড়তে হতো। রুবিয়া বেগমের মতো একই ধরনের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ওই উপজেলার কৃষক রেজাউল করিম। ‘এ-কার্ড’-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ধরনের ঋণ সুবিধা পেয়ে তার ফসল উৎপাদন আগের চেয়ে সহজ ও উন্নত হয়েছে। এ কার্ড ব্যবহার করে যখন যে কৃষি উপকরণ দরকার হয় তা তিনি হাতের কাছে পেয়ে যান। এ নিয়ে কোন ঝামেলা পোহাতে হয় না। সময়মতো সার, কীটনাশক ও জ্বালানি পাওয়ায় ফসল উৎপাদনও ভাল হচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি মৌসুমি ফসলের ভাল দাম পেতে উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও বাজারজাতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এ-কার্ড’ পাওয়ায় ফসল উৎপাদনের শতভাগ নিশ্চয়তা মিলছে। এখন উৎপাদিত ফসল মৌসুমের শেষ পর্যন্ত সংরক্ষণ ও বাজারজাত করার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হলে কৃষকরা বেশি উপকৃত হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল আলম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘কৃষি ঋণ’ প্রকল্পের আওতায় তাদের ব্যাংক কৃষকদের মাঝে এ ঋণ বিতরণ করে থাকে। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে তাদের সহায়তা দিয়ে থাকে এসডিসি ও এনজিওগুলো। তারা প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে এ কার্ড বিতরণে সহযোগিতা করেন। ‘এ-কার্ড’ মডেলের উদ্ভাবক ও মূল পরিকল্পনাকারী ‘ইউএসআইডি’র (এগ্রিকালচার এক্সটেশন সাপোর্ট এ্যাক্টিভিটি-এইএসএ) চীফ অব পার্টি (সিওপি) বিদ্যুৎ কুমার মহলদার বলেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে ‘এ-কার্ড’-এর প্রচলন করা হয়েছে। যাদের নগদ অর্থের সঙ্কট রয়েছে এবং যারা প্রচলিত ব্যাংক সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সেসব কৃষকের কথা বিবেচনা করে নেয়া হয়েছে এ উদ্যোগ। মৌসুমের শুরুতে চাষাবাদের সময় তারা যেন প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ পেতে সমস্যায় না পড়েন। তিনি আরও বলেন, ‘এ-কার্ড’ দেশের মাঠপর্যায়ে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য অপরিসীম সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এর বদৌলতে তারা খুব সহজেই ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন। পাশাপাশি রয়েছে অত্যন্ত স্বল্প সুদের সুবিধা ও সহজশর্তে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সুযোগ। বিদ্যুৎ কুমার মহলদার বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘এ-কার্ড’-এর কারণে একদিকে কৃষকরা নিয়মিত ব্যাংকের মাধ্যমে নিশ্চিত ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন এবং এনজিওগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিলে সপ্তাহান্তে কিস্তি পরিশোধের জন্য তাদের ওপর যে বাড়তি চাপ থাকে সেটি থাকছে না। তিনি ‘এ-কার্ড’-এর ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে আরও বলেন, মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ব্যাংকের স্থানীয় এজেন্ট, এনজিও, কৃষক এবং নির্ধারিত কৃষি উপকরণ বিক্রেতাদের মধ্যে সমন্বয় করে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত হয়। এতে কৃষকরা সময়মতো উপকার পান। কৃষি উপকরণ কেনা নিয়ে তাদের বাড়তি উদ্বেগ পোহাতে হয় না বা নগদ অর্থ সংস্থানের ঝামেলা থাকে না। এ ব্যবস্থার মধ্যমে একজন কৃষক কৃষি উপকরণ সরবরাহকারীকে কার্ডটি দেখালে তিনি তার মোবাইল ফোনের সাহায্যে ক্রেতার (কৃষকের) ব্যাংক হিসাব থেকে পাওনা টাকা কেটে নেন। কৃষক তার হিসাব থেকে কত টাকা কেটে নেয়া হল তা তিনি তার মোবাইলে তাৎক্ষণিক দেখতে পান। পরে উপকরণ সরবরাহকারী তার সুবিধামতো সময়ে এজেন্ট ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে সে অর্থ উত্তোলন করেন। এ প্রকল্পের আওতায় এইএসএ স্থানীয় পর্যায়ে ‘এ-কার্ড’ বিতরণের জন্য ক্ষুদ্র কৃষকদের নির্বাচিত করে। ‘এমপাওয়ার’ ও ‘কেয়ার’ এ কাজে কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। ব্যাংকের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে ডিজিটাল যোগাযোগ (এনএফসি) মাধ্যম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিদ্যুৎ কুমার মহলদার বলেন, ‘এ-কার্ড’-এর মাধ্যমে কৃষকদের জন্য ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা পর্যায়ক্রমে দেশের অন্য অঞ্চলেও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাতাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত ‘তহবিল’ পেলে এ উদ্যোগ অন্য দেশেও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
×