ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

বৈশাখী মেলা সেকাল একাল

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

বৈশাখী মেলা সেকাল একাল

বছর ঘুরে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পহেলা বৈশাখ। মহাকালের চাকায় সময় পাক খায়, সতত সঞ্চরণশীল সময়ের হাতে হাত রেখে আবারও আসে নতুন বছর, নতুন ভাবনা। বাঙালীর সার্বজনীন পালা-পার্বণ যাই বলুন, পহেলা বৈশাখ তার মধ্যে অন্যতম। নগরে বৈশাখ উদ্যাপন উপলক্ষে কী কী আয়োজন-এন্তেজাম থাকে, এ নিয়ে এন্তার লেখাজোখা হচ্ছে। আমি বরং খানিক অতীতচারী হই, একটু জেনে আসি আমাদের কালে গ্রামীণ বাংলায় পহেলা বৈশাখে কেমন কী উৎসব উদ্যাপন হতো। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ঘরোয়া আয়োজন হতো, ওইদিন রাতে খেতে বসেই বুঝে যেতাম বৈশাখ আসছে। বাচ্চারা সুর করে পড়ত ‘আম পাকে বৈশাখে কুল পাকে ফাগুনে, কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।’ অর্থাৎ আমের দিকে খুব ঝোঁক ছিল তখন। গাঁয়ের কৈশোর মানে জীবনের প্রতি উন্মাতাল ভালবাসা। আর আমাদের কাছে বৈশাখ মানে আমের অম্ল-মধুর স্বাদ আর বৈশাখী মেলার খবর। নিয়ম করে আমরা সব জুটতাম বৈশাখী মেলায়। বন্ধুরা মাকড়সার মতো শু-ি মেলে দিয়ে খবর আনত- আজ অমুক গ্রামে মেলা হচ্ছে, কাল হবে গঞ্জে। ব্যস আমরা অমনি মেলায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। মেলার খরচ বাবদ দুটো টাকা হাতানোর জন্য মা-বাবার কাছে মেলা ঘ্যানঘ্যান। টাকা দিয়ে কী হবে? বাবা খেকুরে গলায় বলতেন। ত্যাঁদোড় ছেলে তেতো গলায় বলে, কেন বাবা, টাকা দিয়ে কী হয় তুমি জান না! মেলায় গিয়ে ঘুড়ি কিনব, মিষ্টি খাব, বাঁশি বাজাব। বেঁচে গেলে তোমার জন্য মিষ্টি পানও আনব। ব্যস, অমনি মায়ের মন গলে জল। আহা, দাও না দুটো টাকা। বলতেন মা। ইস, মাকে যে তখন কী মিষ্টি লাগত! ঠিক মসলা দেয়া খিলিপানের মতো। খুব তরমুজ পাওয়া যেত তখন। তবে বাঙ্গি-ফুটি তেমন মুখে রুচত না। ফুলবাবুটি সেজে দলবেঁধে বৈশাখী মেলায় গিয়ে মোরগ লড়াই দেখতাম, কোন কোন মেলায় ষাঁড়ের লড়াইও হতো। মেলা প্রাঙ্গণে দোকান গড়া নিয়ে ক্যাঁচাল-ফেসাদ যেন মেলারই অংশ। সারি সারি খেলনার দোকান, বাঁশির ফুঁ, বন্ধুদের নিয়ে নাগরদোলায় চড়া ছিল অনেকটা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। বৈশাখে কাঠফাঁটা গরম, তবে গাঁয়ের ছেলে তো, তাই তেমন গায়ে লাগত না। পরনে ফিনফিনে সাদা ফতুয়া বা পাঞ্জাবি, গাঁয়ে তখনও পলো টি-শার্টের চল শুরু হয়নি, ফতুয়ার রং নিয়ে বন্ধুদের মাঝে খুনসুটি হতো। কে সাদা রং পরল, কারটা লাল, কালো পরা অনুচিত, এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতো। কে কী খেয়েছে বৈশাখের পহেলা তারিখে তা নিয়েও আলোচনা হতো। বছরের শুরুতে ভালমন্দ কিছু খাওয়া উচিত, মা-কাকিরা তাই একটু মাংস, নিদেনপক্ষে রুইমাছ, বা ডিম রান্না করতেন। অবস্থাপন্ন যারা, তারা খাসি জবাই দিত আর যাদের অবস্থা পড়তির দিকে তারা মোরগ নয়ত হাঁস রান্না করত। যাদের হেঁসেলে কিছুই হতো না, সেই সব বন্ধুরা নিমন্ত্রণ পেত অন্যদের ঘরে। এই নিয়ে ভুলেও কেউ কিন্তু হামবড়া গোছের কিছু বলত না। ভালবাসা ছিল আমাদের মাঝে, নিখাদ বন্ধুত্ব। বেশ মনে আছে, আমাদের গাঁয়ে একবার পুতুলনাচ এলো। সুতোয় বাঁধা পুতুল সব নাচছে। সাঁজ নামার আগেই পুরো গ্রাম যেন ভেঙে পড়ল মাঠে। নাচিয়েরা তত পটু ছিল না, তবে গাঁয়ের মানুষকে খুশি করার জন্য তাই ঢের। কাপড়চোপর পরা টেপা পুতুল নিজে থেকে নাচছে, এর চেয়ে মজার কা- আর কী হতে পারে! সত্যি বলতে, মানুষ তখন খুব সহজেই খুশি হতো, অত লোভ বা লাভের দরকার পড়ত না। গাঁয়ে এখনও মেলা হয়। বৈশাখের শুরুতে বিশেষ কিছু আয়োজন থাকে। দোকানিরা খদ্দেরদের হালখাতার নিমন্ত্রণ দেয়। আগে ওটা ছিল ক্রেতার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার বহির্প্রকাশ, আর এখন হালখাতা মানে বকেয়া আদায়ের কৌশল। তখন মেলা ছিল মিলনস্থল, এখন এসব আচার-অনুষ্ঠানে কার কত টাকা আছে সেটা দেখানোই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বছরের শুরুটা সবার ভাল হোক, দেশ ও মানুষের প্রতি আমরা আরও বেশি আন্তরিক হয়ে উঠি, এই প্রত্যাশা থাকল। শুভ নববর্ষ ১৪২৪। মোহাম্মদপুর, ঢাকা থেকে
×