ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেনহাজুল ইসলাম তারেক

প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভাসি

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভাসি

বৈশাখ আসছে। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে শহরের অলিগলিতে। নতুন রূপে, নতুন ঢঙে সেজে ওঠার প্রস্তুতি চলছে। পহেলা বৈশাখÑ হতাশা আর ব্যর্থতা পেরিয়ে প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার দিন। কতকিছু বদলে যায় এর আগমনে, জীবনে নতুন করে প্রাণের জোয়ার জাগে। কৃত্রিম খোলস পাল্টে এ দিন আমরা প্রত্যেকেই বাঙালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। বাজারে এরই মধ্যে ইলিশের দাম বাড়তে শুরু করেছে। স্বাভাবিক, পান্তা-ইলিশ ছাড়া আমাদের শহুরে বৈশাখ ইদানীং কল্পনাই করা যায় না। প্রচ- ভিড় জমতে শুরু করেছে বিপণিবিতানগুলোতেও। পহেলা বৈশাখে নতুন পোশাক পরতেই হবেÑ এটি যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। চৈত্রের শুরু থেকেই তাদের দোকানগুলো ভরে উঠেছে দেশীয় অনুষঙ্গে, লাল-সাদা পোশাক আর মাটির হাঁড়িকুড়িতে। আমার তো মনে হয়, প্রকৃতিতে তেমন কোন পরিবর্তন না হলেও দোকানগুলোর দিকে তাকালেই বৈশাখের আগমনী বার্তা টের পাওয়া যায়। এই উৎসবে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ মনের আনন্দে অংশগ্রহণ করে। কেবল নিজ বাড়িতে এটি উদ্যাপন করা যায় না, যেতে হয় বাইরেও। সবার অংশগ্রহণেই এর আনন্দ পূর্ণতা পায়। রমনার বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব কিংবা চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফল করে তোলার পেছনেও আছে বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ। আজকাল রাস্তাজুড়ে বিশাল সব আলপনা করা হয়, নগরী সেজে ওঠে ফুল আর রঙিন আলোয়। আমাদের গ্রামগুলোতেও এখন বর্ষবরণের গান, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, নতুন পোশাক পরা- সবই হয়। আর বৈশাখী মেলা তো আছেই। গ্রামে পহেলা বৈশাখের ভোরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় ঘরবাড়ি, উঠান এবং আশপাশের জায়গা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এই প্রচলন আমাদের ছোটবেলাতেও ছিল। মাকে দেখতাম দুই দিন আগ থেকেই ঝাড়পোছ করছেন ঘর। পর্দা ধোয়া হচ্ছে, নতুন চাদর বিছানো হচ্ছে বিছানায়। বিগত বছরের সব আবর্জনা দূর করে বৈশাখ নিয়ে আসবে শুচি, শুভ্রতা আর নতুনত্ব- এমন একটি বিশ্বাস থেকে এই সংস্কৃতির জন্ম। তবে আজকাল এ নিয়ে যে আনন্দ আর উন্মাদনা, আমাদের ছোটবেলায় তেমন ছিল না। বৈশাখ উদ্যাপিত হতো তখনও, তবে তার রূপ ছিল স্নিগ্ধ, নরম। উদ্যাপন করা হতো চৈত্রসংক্রান্তি। বিগত বছরের সব জরাব্যাধি দূর হয়ে যাবেÑ এই বিশ্বাসে প্রচলিত-অপ্রচলিত সব ধরনের শাকের সমাহার ঘটত চৈত্রসংক্রান্তির খাবারে। এখনও অনেকেই পালন করেন এই রীতি। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করতেন মূলত ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোকজন। হালখাতা খোলা হতো, দোকানে আসা গ্রাহকদের তারা মিষ্টি খাওয়াতেন। আর বাসায় অন্য দিনের তুলনায় ভাল খাবারের আয়োজন করতেন মা। একটা বিশ্বাস ছিল, প্রথম দিন ভাল খাবার খেলে সারা বছরই ভাল খাবার খাওয়ার সুযোগ ঘটবে। খেয়ে-দেয়ে আমরা মেলায় যেতাম। শহরে এখন যেমন বৈশাখী মেলা বসে, তখনও বসত। তবে গ্রামের মেলার আলাদা একটা আমেজ ছিল। সেখানে গিয়ে নাগরদোলায় দোলাটা ছিল এক রকম বিস্ময়, বয়স্করাও দুলতেন। কিছুক্ষণের জন্য জীবনের সব হতাশা-গ্লানি ভুলে শিশু হয়ে উঠতেন তারা। মেলায় বিক্রি হতো বিচিত্র সব সামগ্রী। মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল তো ছিলই, সঙ্গে পুতুল, নানা রকম খেলনা, পাটের তৈরি জিনিসপত্র, তালপাতার পাখা, ঝিনুকের মালা, বাঁশি, পুঁতির মালা, কাচের চুড়ি ইত্যাদি পাওয়া যেত। এই মেলা এখনও টিকে আছে। গ্রাম ও শহরে। আমাদের বৈশাখ মানেই ছিল বৈশাখী মেলায় গিয়ে হাতভর্তি জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরা। একটা জিনিস খুব ভাল লাগত। তা হলো চিনি দিয়ে তৈরি হাতি, ঘোড়া, নানা রকম পুতুল। নতুন পোশাক পরার রেওয়াজ আগে ছিল না বললেই চলে। পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরা হতো, কেউ কেউ হয়ত নতুনও বানাত। তবে সেটিও লাল-সাদার মতো নির্দিষ্ট রঙের নয়। আমার যত দূর মনে পড়ে, নতুন পোশাক পরার রেওয়াজটা বর্তমান ধীরে ধীরে ব্যাপকতা পেতে থাকে, পাশাপাশি ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম। লাল-সাদা রঙ নির্দিষ্ট হয়ে ওঠার পেছনে প্রার্থনার একটি সম্পর্ক আছে মনে হয়। বিশেষ করে শাড়ির ক্ষেত্রে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি মূলত আরতির শাড়ি। সাদাকে এমনিতে পবিত্রতার প্রতীক ধরা হয় আর তার সঙ্গে লাল মানে নতুন সূর্য। এ দুটো বাঙালীর নিজস্ব রঙ হয়ে উঠেছে। তবে এখন সেখানেও এসেছে বৈচিত্র্য। পোশাকে আজকাল হলুদ, কমলা, সবুজ- নানা রঙের মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। পার্বতীপুর, দিনাজপুর থেকে
×