ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এস এম মুকুল

হাওড়াঞ্চলের দুর্যোগ ও করণীয়

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৯ এপ্রিল ২০১৭

হাওড়াঞ্চলের দুর্যোগ ও করণীয়

হাওড়ের কৃষকের সর্বনাশ হয়ে গেল। দেশের হাওড়াঞ্চল সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার কয়েক শ’ হাওড়ে বছরের একমাত্র ফসল বোরো কাঁচা অবস্থায় অকাল বন্যায় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। যেখানে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদনের আশা ছিল তার সবটাই নিঃশেষ হয়ে কৃষকের মাথায় হাত। একদিকে সব ফসলডুবির ক্ষতি, কৃষকের গোলা খালি, অপরদিকে সারা বছরের খোড়াকি ও সংসারের যাতবীয় খরচের দুশ্চিন্তা। তার ওপর আরও আছে ফসল করার জন্য লাখ লাখ টাকা ঋণের বোঝা। যে কৃষকের শরীরের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য মজুদ বাড়ায়। সেই হাওড়ের কৃষকের সারা বছরের খোড়াকি আর জীবনযাপনের একমাত্র অবলম্বন এই একটি ফসল নিঃশেষ হয়ে গেল। এসব মিলিয়ে হাওড়বাসীর কান্নার বিলাপে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মহাধীরগতি! হাওড় এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত ২০ বছর মেয়াদী ‘হাওড় মহাপরিকল্পনা’ নিয়েছে সরকার। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো- চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পগুলোই চলছে সবচেয়ে ধীরগতিতে। জানা গেছে, গৃহীত ১৫৪টি প্রকল্পের ১৪টির কাজ চলছে। ১১টির চলছে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত ২০১৪ সালে শুরু হওয়া কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার ২৯টি হাওড়ে বন্যা ব্যবস্থাপনার ৯৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা যার অগ্রগতি মাত্র ১৩ শতাংশ। এ প্রকল্পের ৮৮ কোটি টাকার আরেক অংশ হাওড় এলাকায় গ্রামীণ সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) যার অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। হাস্যকর কিছু খবর জানা গেছে, এমন প্রকল্পও রয়েছে, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে কিন্তু কাজের অগ্রগতি ২০ ভাগেরও কম। ৫২টি হাওড়ে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৭০৪ কোটি টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রায় দুই লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমির ফসল বর্ষায় বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৭ দশমিক ৯ ভাগ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়ক, সেতুর উন্নয়ন এবং গ্রামগুলোকে হাওড়ের পানির ঢেউয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। ২০১২ সালে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে শেষ হবার কথা ২০১৯ সালে। কিন্তু হাতে দুই বছরেরও কম সময় থাকলেও, প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ৫৬ শতাংশ। মঙ্গার মতো হাওড়ের অকাল বন্যাও ঘুঁচবে প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতা আর উদ্যোগে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা ঘুঁচে গেছে। সেখানে মঙ্গা বলে আর কিছু নেই। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এলাকায় ব্রি-৩৩ ও ৩৯ জাতের ধান আবাদ করে মানুষের খাদ্য সঙ্কট এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জেনেছি, বিনা-১১, ১২ হচ্ছে জলমগ্ন সহিষ্ণু ধানের জাতটি ২৫ দিন পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে থাকলেও টিকতে পারবে। প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন উৎপাদন হবে। অনুরূপ বিনা-১৩ সুগন্ধি জাতের আমন ধান ১৩৮ থেকে ১৪২ দিনে ঘরে তোলা সম্ভব। ফলন হবে হেক্টর প্রতি চার থেকে সোয়া চার টন। দেশের হাওড় এলাকার এই জাতের ধান নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক উদ্ভাবিত নারিকা জাতের ধান খরা মৌসুমেও ভাল ফলন দেয়। জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে আমন মৌসুমের জন্য আরও পাঁচটি উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের বীজ আনা হয়েছে। মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ দিনে এ জাতের ধানগুলোর ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। দেশের হাওড় এলাকার এই জাতের ধান নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। হাওড় দুর্যোগ কাটাতে কতিপয় প্রস্তাবনা প্রথমে হাওড় এলাকাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণার ব্যবস্থা করা। ২. ফসলের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা। ৩. এই ক্ষতির কারণ বা কারা দায়ী এ বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনা। ৪. হাওড়বাসীর জন্য আপদকালীন সময়টায় রেশন ব্যবস্থায় চাল, চিনি, ডাল, তেল, লবণ ইত্যাদি দেয়া। ৫. আগামী বছরের চৈত্র মাস পর্যন্ত এক বছর এই দুর্যোগ মোকাবেলা কার্যক্রম চালানো। ৬. ফসল বোনার জন্য উন্নত বীজ উদ্ভাবন করা। ৭. আগামী বছরের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে হাওড়ে বীজ বোনার জন্য বীজ সহায়তা ও কৃষির খরচ মেটাতে ব্যাংক ঋণ সহায়তা দেয়া। ৮. সদাশয় কৃষি মন্ত্রণালয়, হাওড় উন্নয়ন বোর্ড হাওড়াঞ্চলে বোরো ফসল কম সময়ে উৎপাদনশীল ধানের জাত কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা। ৯. কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া, ঋণ সহায়তা দেয়া। ১০. শুকনো মৌসুমে হাওড়ের পতিত জমিতে হাওড়ের মাটিতে ফলন উপযোগী সরিষা, মাষকলাই, মসুরকলাই, ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করা। ১১. হাওরের নদী ও খালগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে খনন করা। ১২. বর্ষায় আখ চাষ করার ব্যবস্থা করা। ভাসমান সবজি চাষ, কুটির শিল্প, গরু-ছাগল (ব্ল্যাকবেঙ্গল)-মহিষ পালন, হাস ও মুরগির খামার প্রভৃতি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে হাওড়ের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে।
×